সূরা আল-আলাক; হযরত মোহাম্মদ (স.) এর কাছে নাজিলকৃত কুরআনের প্রথম আহ্বান
গভীর রাত। নিঃস্তব্ধ পাহাড়ের বুক চিরে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন এক ব্যক্তি। একাকিত্বে ডুবে থাকা তাঁর হৃদয়ে হঠাৎ নেমে এল আলো, কাঁপিয়ে দিল বিশ্ব ইতিহাসের প্রথম পৃষ্ঠা। এক মহাসত্তা বললেন—“পড়ো!” সেই শব্দের প্রতিধ্বনি আজও অনুরণন তোলে বিশ্বমানবতার অন্তরে।
এভাবেই সূচনা হয় ইসলামি ওহির, কুরআনের, এবং এক মহান নবুয়তের। কুরআনের প্রথম নাজিল হওয়া আয়াতসমূহ ছিল সূরা আল-আলাকের অংশ। এটি শুধু একটি সূরা নয়, বরং মানবজাতির প্রতি আল্লাহর প্রথম জ্ঞান-আহ্বান। সূরা আল-আলাক আমাদের শেখায়—জ্ঞানের গুরুত্ব, আত্মশুদ্ধি, এবং অহংকারের পরিণতি।
সূরা আল-আলাক: একটি ঐতিহাসিক পরিচিতি
সূরা আল-আলাক (العلق) কুরআনের ৯৬ নম্বর সূরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ হয় এবং এতে মোট ১৯টি আয়াত রয়েছে। কুরআনের ৩০তম পারায় এটি স্থান পেয়েছে। এই সূরার প্রথম ৫ আয়াতই হল কুরআনের প্রথম ওহি, যা রাসূল মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট অবতীর্ণ হয় গার হেরা-তে।
সূরা আল-আলাকের পূর্ণ পাঠ
আরবি, উচ্চারণ ও বাংলা অনুবাদ
নিচে সূরার প্রতিটি আয়াতের আরবি, বাংলা উচ্চারণ ও শুদ্ধ অনুবাদ দেওয়া হলো:
| আয়াত | আরবি | উচ্চারণ | অর্থ |
|---|---|---|---|
| ১ | اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ | ইকরা বিস্মি রাব্বিকাল্লাযী খালাক | পড়ো তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। |
| ২ | خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ | খালাকাল ইনসানা মিন ‘আলাক | তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্ত থেকে। |
| ৩ | اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ | ইকরা ওয়া রাব্বুকাল আকরাম | পড়ো, আর তোমার প্রভু সবচেয়ে মহান। |
| ৪ | الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ | আল্লাযী আল্লামা বিলকালাম | যিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন। |
| ৫ | عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ | আল্লামাল ইনসানা মা লাম ইয়ালাম | তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না। |
| ৬ | كَلَّا إِنَّ الْإِنسَانَ لَيَطْغَىٰ | কাল্লা ইন্নাল ইনসানা লায়াতগা | না, মানুষ সীমা অতিক্রম করে। |
| ৭ | أَن رَّآهُ اسْتَغْنَىٰ | আন্ রা-আহুসতাগনা | কারণ সে মনে করে সে অভাবমুক্ত। |
| ৮ | إِنَّ إِلَىٰ رَبِّكَ الرُّجْعَىٰ | ইন্না ইলা রাব্বিকা রুজআ | অবশ্যই তোমার প্রভুর কাছেই প্রত্যাবর্তন। |
| ৯ | أَرَأَيْتَ الَّذِي يَنْهَىٰ | আরাআইতাল্লাযী ইয়ানহা | তুমি কি দেখেছ তাকে, যে নিষেধ করে? |
| ১০ | عَبْدًا إِذَا صَلَّىٰ | আব্দান ইজা সাল্লা | এক বান্দাকে যখন সে নামাজ পড়ে। |
| ১১ | أَرَأَيْتَ إِن كَانَ عَلَى الْهُدَىٰ | আরাআইতা ইন কানা আলাল হুদা | যদি সে সৎপথে থাকে? |
| ১২ | أَوْ أَمَرَ بِالتَّقْوَىٰ | আও আমারা বিইত্তাকওয়া | অথবা তাকওয়ার নির্দেশ দেয়? |
| ১৩ | أَرَأَيْتَ إِن كَذَّبَ وَتَوَلَّىٰ | আরাআইতা ইন কাযযাবা ওয়া তাওয়াল্লা | যদি সে মিথ্যা বলে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়? |
| ১৪ | أَلَمْ يَعْلَمْ بِأَنَّ اللَّهَ يَرَىٰ | আলাম ইয়ালাম বিআন্নাল্লাহা ইয়ারা | সে কি জানে না, আল্লাহ দেখেন? |
| ১৫ | كَلَّا لَئِن لَّمْ يَنتَهِ لَنَسْفَعًا بِالنَّاصِيَةِ | কাল্লা লাইন লাম ইয়ানতাহি লানাসফা-আম বিন নাসিয়া | সে যদি বিরত না হয়, আমরা ধরে ফেলব তার কপাল। |
| ১৬ | نَاصِيَةٍ كَاذِبَةٍ خَاطِئَةٍ | নাসিয়াতিন কাজেবাতিন খাতিয়া | মিথ্যাবাদী ও পাপাচারী কপাল। |
| ১৭ | فَلْيَدْعُ نَادِيَهُ | ফালইয়াদ‘উ নাদিয়াহু | সে ডাকুক তার সঙ্গীদের। |
| ১৮ | سَنَدْعُ الزَّبَانِيَةَ | সানাদ‘উ যাবানিয়া | আমরা ডেকে আনব প্রহরীদের। |
| ১৯ | كَلَّا لَا تُطِعْهُ وَاسْجُدْ وَاقْتَرِبْ | কাল্লা লা তুতি‘হু ওয়াসজুদ ওয়াকতারিব | না, তুমি তার কথা শুনো না। সিজদা করো ও নিকটবর্তী হও। |
প্রেক্ষাপট: মানব ইতিহাসে প্রথম ওহির মুহূর্ত
ইসলামি বিশ্বাস অনুসারে, হেরা গুহায় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর উপর নাজিল হয় এই সূরার প্রথম পাঁচ আয়াত। তখন তাঁর বয়স চল্লিশ। ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) এসে তাঁকে নির্দেশ দেন—“পড়ো”। তখন থেকেই শুরু হয় নবুওয়তের নতুন অধ্যায়।
পরবর্তীতে সূরার বাকি অংশ নাজিল হয়, যখন কুরাইশদের একজন নেতা (আবু জাহল) রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে সিজদা থেকে বিরত রাখতে চেয়েছিল। আল্লাহ এসব আয়াতের মাধ্যমে তাকে কঠোরভাবে সতর্ক করেন।
তাফসির ও বার্তা: জ্ঞান, আত্মশুদ্ধি ও অবাধ্যতার পরিণতি
সূরার মূল বার্তা তিনটি স্তরে বিশ্লেষণ করা যায়:
১. জ্ঞানের গুরুত্ব:
সূরার সূচনা হয়েছে “পড়ো” শব্দ দিয়ে। ইসলামে জ্ঞান, লেখা ও শিক্ষা—এই তিনটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং এটাই ইসলামি সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করেছে।
২. অহংকারের নিন্দা:
মানুষ যখন নিজেকে আত্মনির্ভর ভাবে, তখন সে সীমালঙ্ঘন করে। আল্লাহ মনে করিয়ে দেন, প্রত্যেকের ফিরে যাওয়া হবে তাঁর কাছেই।
৩. সিজদা ও আল্লাহর নৈকট্য:
শেষ আয়াতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে: সিজদা করো এবং আল্লাহর কাছে নিকটবর্তী হও। এটি আত্মিক প্রশান্তি ও ইবাদতের গভীর শিক্ষা।
আমল ও আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা
-
সূরার ১৯ নম্বর আয়াতে সিজদা তিলাওয়াত রয়েছে, যা তিলাওয়াত বা শ্রবণের পর আদায় করা মুস্তাহাব।
-
শিক্ষার্থীদের জন্য এটি একটি অনুপ্রেরণামূলক সূরা, কারণ এটি কলম ও জ্ঞানের মাধ্যমে আলোকিত হওয়ার আহ্বান জানায়।
-
যারা অহংকার ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ অমান্য করে, তাদের জন্য এটি এক কঠোর সতর্কবার্তা।
উপসংহার
সূরা আল-আলাক কেবল কুরআনের একটি সূরা নয়, বরং এটি এক বিপ্লবের সূচনা—জ্ঞান, বিনয় ও আত্মিক উন্নয়নের পথে।
মানবজাতির প্রতি আল্লাহর প্রথম বার্তা ছিল—“পড়ো”। এবং শেষ নির্দেশনা ছিল—“সিজদা করো ও নিকটবর্তী হও।”
এই সূরার মধ্যে লুকিয়ে আছে জ্ঞানের চাবিকাঠি, ঈমানের শক্তি এবং আত্মশুদ্ধির মৌলিক সূত্র।
এস এম মেহেদী হাসান 

























