নকল পাসপোর্টে তুরস্কে হামাস প্রধানের বিধবা স্ত্রী, গোপনে বিয়ে: গাজা যুদ্ধের ছায়ায় পালিয়ে বাঁচার লড়াই
আন্তর্জাতিক ডেস্ক | ২৭ জুলাই ২০২৫ — ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধের মধ্যেই হামাসের শীর্ষ নেতাদের পরিবারের পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, নিহত হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারের স্ত্রী সামার মোহাম্মদ আবু জামা নকল পাসপোর্ট ব্যবহার করে গাজা থেকে তুরস্কে পালিয়ে গেছেন এবং সেখানেই গোপনে পুনরায় বিয়েও করেছেন।
সংবাদমাধ্যম NDTV এবং ইসরায়েলি ওয়েবসাইট ওয়াইনেট–এর বরাতে জানা গেছে, সামার তুরস্কে এক গোপন নেটওয়ার্কের সহায়তায় গাজা ত্যাগ করেন। সেই নেটওয়ার্ক হামাসের শীর্ষ নেতাদের পরিবারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে জাল কাগজপত্র, ভুয়া চিকিৎসা প্রতিবেদন এবং উচ্চপর্যায়ের সহযোগিতা ছিল মূল ভিত্তি।
সিনওয়ারের মৃত্যুর আগেই গাজা ত্যাগ
২০২৪ সালের ১৬ অক্টোবর ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানে হামাসের সাবেক প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিহত হন। গাজার রাফাহর তাল আল-সুলতান এলাকায় একটি ড্রোন হামলায় ধ্বংসস্তূপে আশ্রয় নেওয়া অবস্থায় তাকে লক্ষ্য করে হত্যা করা হয়। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি ধুলোমাখা মুখে একটি চেয়ারে বসে আছেন এবং একটি লাঠি দিয়ে ড্রোন লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারছেন, এর কিছুক্ষণ পরেই তিনি নিহত হন।
ইসরায়েলি নিরাপত্তা সূত্র নিশ্চিত করেছে, সামার ও সিনওয়ারের ভাইয়ের স্ত্রী ওই সময়ের আগেই রাফাহ সীমান্ত দিয়ে মিশরে প্রবেশ করেন, এবং সেখানে অন্য এক নারীর নামে জাল পাসপোর্ট ব্যবহার করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, হামাস নেতা ফাতি হাম্মাদ সামারের তুরস্কে দ্বিতীয় বিয়ের আয়োজন করেন। এই হাম্মাদ অতীতেও সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল থেকে হামাস নেতাকর্মী ও তাঁদের পরিবারকে সরিয়ে নেওয়ার কাজে জড়িত ছিলেন।
গাজার মানবিক বিপর্যয় ও নেতাদের গোপন রক্ষার সমালোচনা
গাজায় যখন প্রতিদিন সাধারণ মানুষ বোমার আঘাতে মৃত্যু বরণ করছে, খাদ্য ও ওষুধের জন্য হাহাকার চলছে—তখন হামাস নেতাদের পরিবারের এই পালিয়ে যাওয়া নিয়েও উঠছে নৈতিকতা ও নেতৃত্বের প্রশ্ন।
জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি অবরোধের ২১তম মাসে গাজার প্রায় ৫৯ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে হাজার হাজার শিশু ও নারী রয়েছেন।
চলতি বছরের মার্চ থেকে খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির প্রবেশ প্রায় বন্ধ হয়ে পড়ায় গাজায় চরম দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত অনাহারে ১১১ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে রয়েছে নবজাতক ও শিশু।
প্রায় ১ লাখ নারী ও শিশু চরম অপুষ্টিতে ভুগছে এবং ৭ হাজারের বেশি আহত হয়েছেন সহায়তা সংগ্রহের চেষ্টাকালে, বেশিরভাগই সহায়তা বিতরণ কেন্দ্রের আশপাশে ছিলেন।
জাতিসংঘ-সমর্থিত আইপিসি রিপোর্ট অনুযায়ী:
-
গাজার ২১ লাখ মানুষের প্রায় সবাই চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে।
-
এর মধ্যে প্রায় ৪ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষ “স্টেজ ৫” পর্যায়ের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি।
-
সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে ৫ বছরের নিচের ৭১ হাজার শিশু এবং ১৭ হাজার গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী নারী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানায়, গাজার তিন-চতুর্থাংশ জনগণ চরম খাদ্য সংকটে, অথচ জরুরি সহায়তা সীমান্তেই আটকে আছে, ক্ষুধার্ত মানুষের নাগালের বাইরে।
নৈতিকতা ও নেতৃত্বের প্রশ্ন
বিশ্লেষকরা বলছেন, একজন শীর্ষ নেতার স্ত্রী হিসেবে সামারের পালিয়ে যাওয়া ও পুনরায় বিয়ে—এটি শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং নৈতিক প্রশ্নের মুখে ফেলেছে পুরো নেতৃত্ব কাঠামোকে। যখন গাজার সাধারণ মানুষ জীবন বাজি রেখে রয়ে গেছেন, তখন উচ্চপর্যায়ের পরিবারগুলো বিদেশে আরামদায়ক আশ্রয় খুঁজছেন—এই বৈপরীত্য হামাসের অভ্যন্তরীণ গ্রহণযোগ্যতা এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জবাবদিহি নিয়েও প্রশ্ন তুলছে।
উপসংহার
ইসরায়েল-গাজা সংঘাত শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নেই। এটি ব্যক্তিগত জীবন, পরিবার এবং নেতাদের ভেতরের বাস্তবতা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। সামার আবু জামার ও হামাস নেতৃবৃন্দের পরিবারের এভাবে গোপনে গাজা ত্যাগের ঘটনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর কেড়েছে। এমন সময়ে যখন লাখো মানুষ বেঁচে থাকার লড়াইয়ে জীবন হারাচ্ছেন, তখন প্রভাবশালীদের নিরাপদে পালিয়ে যাওয়া যুদ্ধের প্রকৃত চিত্রকে আরও জটিল করে তুলেছে।
— আহমদুল হাসান/ তাবাসসুম/ এস এম মেহেদী
আহমদুল হাসান 




























