2:14 pm, Sunday, 23 November 2025

প্রেম, প্রতারণা ও একাকীত্ব: যশোরের মনিহার হলে এক তরুণীর দুঃস্বপ্ন

  • Reporter Name
  • Update Time : 12:11:58 pm, Wednesday, 23 July 2025
  • 228 Time View

প্রেম, প্রতারণা ও একাকীত্ব: যশোরের মনিহার হলে এক তরুণীর দুঃস্বপ্ন

ঢাকা | ২৩ জুলাই ২০২৫ | বিশেষ প্রতিবেদন  — একটি দুপুর। একটি সিনেমা হল। এক তরুণী, প্রেমিকের হাত ধরে এসেছিলেন সিনেমা দেখতে। হয়তো একসঙ্গে হাসবেন, কাঁদবেন, অথবা সিনেমার শেষে হাত ধরে হাঁটবেন নরম আলো-আঁধারিতে। কিন্তু বাস্তব জীবনের পর্দায় চলছিল এক ভিন্নধর্মী ‘থ্রিলার’—যেখানে নায়িকা অজ্ঞান হন, আর নায়ক গহনা, টাকা আর ভরসা সব ছিনিয়ে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান।

নড়াইল জেলার কাগজিপাড়া গ্রামের লতা শিকদার (২০), যশোরের ঐতিহ্যবাহী মনিহার সিনেমা হলে পা রেখেছিলেন স্বপ্নের কিছু মুহূর্ত কাটানোর আশায়। কিন্তু প্রেমিকের দেওয়া সেই ‘সারপ্রাইজ’ পরিণত হয় এক দুঃস্বপ্নে।

থ্রিলারের শুরু, বাস্তবতার পরিণতি

প্রেমিক আগেই বলেছিলেন—“আজ তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে!” হয়তো লতা ভেবেছিলেন, একটি আংটি হবে, অথবা হাতে ধরা কিছু গোলাপ। কিন্তু সারপ্রাইজ ছিল ভয়ংকর। সিনেমা চলার মাঝপথে, ঠিক কোন দৃশ্যের সময় লতা অজ্ঞান হন, তা এখনো অজানা। ধারণা করা হচ্ছে, তাকে অজ্ঞান করার জন্য খাওয়ার মধ্যে ওষুধ মেশানো হয় বা স্প্রে ব্যবহার করা হয়।

কিছুক্ষণ পর দর্শকরা লক্ষ্য করেন, এক তরুণী চেয়ারেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছেন। সিনেমা হলের কর্মীরা এগিয়ে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন।

চিকিৎসা ও মানসিক ধাক্কা

চিকিৎসক ডা. মৌসুমি আক্তার জানান, “শারীরিকভাবে এখন তিনি স্থিতিশীল, তবে মানসিকভাবে তিনি এক ধরণের শকের মধ্যে আছেন। বিশ্বাসঘাতকতার ধাক্কা তার মধ্যে গভীরভাবে কাজ করছে।”

লতার সঙ্গে থাকা ব্যাগ, মোবাইল ফোন, গহনা ও নগদ অর্থ সবই নিয়ে গেছে তার ‘প্রেমিক’। এমনকি এখন পর্যন্ত তার পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। কোনো জাতীয় পরিচয়পত্র বা নম্বরও লতার কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

 মাওলানা মুফতি তোফায়েল খান, ইসলামি চিন্তাবিদ ও শেখ বাড়ি মাদরাসার শিক্ষক, বলেন—

“ইসলাম যে সম্পর্ককে স্বীকৃতি দেয় তা হলো বৈধ বিয়ের বন্ধন। অবৈধ সম্পর্ক সবসময়ই বিপদের দরজা খুলে দেয়—শরীরের যেমন ক্ষতি হয়, তেমনি আত্মিক ও সামাজিক ক্ষতিও গভীর হয়। আজ আমরা সমাজে যে প্রেমের নামে প্রতারণা, অজ্ঞান করা, এমনকি সর্বস্ব লুটের ঘটনা দেখছি—তা মূলত আমাদের ধর্মীয় অনুশাসন থেকে দূরে সরে যাওয়ারই ফল।”

“ছেলেমেয়েদের উচিত বৈধ পথ বেছে নেওয়া, পরিবার ও সমাজের অনুমোদিত সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেওয়া। একইসাথে অভিভাবকদেরও দায়িত্ব সন্তানদের যথাযথ ইসলামী শিক্ষা ও সচেতনতা দেওয়া, যাতে তারা আবেগে নয়, বিবেকে পথ চলে। ইসলাম চায় না, একজন তরুণী সিনেমা হলে গিয়ে প্রেমিকের হাতে সর্বস্ব হারাক—ইসলাম চায় সে হোক মর্যাদাপূর্ণ একজন নারী, নিরাপদ সমাজের নাগরিক।”

সামাজিক বাস্তবতা ও প্রেমের ফাঁদ

এই ঘটনার গভীরে রয়েছে সমাজের একটি উদ্বেগজনক বাস্তবতা—অনলাইনে গড়ে ওঠা সম্পর্ক, তড়িঘড়ি বিশ্বাস, আর প্রেমের নামে প্রতারণা। প্রতিদিন সামাজিক মাধ্যমে শত শত সম্পর্ক গড়ে উঠছে, কিন্তু কতজন জানে, অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তি সত্যিই কে?

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের সহকারি অধ্যাপক ডাঃ পলাশ রায় বলেন, তরুণ-তরুণীরা যখন পারিবারিক সম্পর্ক ও সামাজিক সহানুভূতির অভাবে একাকীত্বে ভোগেন, তখন তারা আবেগের জায়গায় নিরাপত্তা খোঁজেন। সেই জায়গাটি খুব সহজেই হয়ে ওঠে প্রতারণার ক্ষেত্র।

সাংবাদিকদের চোখে

সিনিয়র সাংবাদিক কল্লোল আহমেদ বলেন,  এটি নিছক একটি প্রতারণার ঘটনা নয়। এটি একজন নারীর বিশ্বাস, ভালোবাসা ও নিরাপত্তার জায়গায় আঘাত করার একটি চিত্র। যখন একটি মেয়ে তার সামাজিক পরিচয় ভুলে, শুধু বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে কারও সঙ্গে সময় কাটাতে আসেন—তখন এমন আঘাত কেবল শারীরিক নয়, মানসিক এক ধরনের সহিংসতা।

আমরা কী শিখলাম?

এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—

  • প্রেমের নাম করে অনেক অপরাধই সংগঠিত হয়।

  • নারীদের সুরক্ষা শুধু আইনের বিষয় নয়, সামাজিক সচেতনতারও।

  • তরুণ-তরুণীদের উচিত, অনলাইন বা অফলাইন সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু যাচাই-বাছাই করা।

উপসংহার

লতা শিকদারের এই গল্প হয়তো আগামী সপ্তাহে অন্য খবরের নিচে চাপা পড়ে যাবে। কিন্তু তার চোখের শূন্যতা, বিশ্বাসঘাতক প্রেমিকের ফেলে যাওয়া ছায়া আর একাকীত্ব—তা থাকবে তার জীবনে অনেকদিন।

তাকে নিয়ে কেউ হয়তো আর সিনেমা দেখতে যাবে না। কিন্তু তার গল্প হয়তো কাউকে চোখ খুলতে সাহায্য করবে। যেন পরেরবার, কেউ “সারপ্রাইজ আছে” বললে, একটু থেমে, একটু ভেবে নেয়।

লেখক: এস এম মেহেদী হাসান, E-mail : rumeenews@gmail.com, মোবাইল : ০১৭১১ ৯৩ ৪৩ ৫৮

— মিনারা আজমী/ তাবাসসুম/ সালেহ আহমদ

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Popular Post

দ্রব্যমূল্য কমানো ও সর্বস্তরে রেশনিং চালুর দাবি

প্রেম, প্রতারণা ও একাকীত্ব: যশোরের মনিহার হলে এক তরুণীর দুঃস্বপ্ন

Update Time : 12:11:58 pm, Wednesday, 23 July 2025

প্রেম, প্রতারণা ও একাকীত্ব: যশোরের মনিহার হলে এক তরুণীর দুঃস্বপ্ন

ঢাকা | ২৩ জুলাই ২০২৫ | বিশেষ প্রতিবেদন  — একটি দুপুর। একটি সিনেমা হল। এক তরুণী, প্রেমিকের হাত ধরে এসেছিলেন সিনেমা দেখতে। হয়তো একসঙ্গে হাসবেন, কাঁদবেন, অথবা সিনেমার শেষে হাত ধরে হাঁটবেন নরম আলো-আঁধারিতে। কিন্তু বাস্তব জীবনের পর্দায় চলছিল এক ভিন্নধর্মী ‘থ্রিলার’—যেখানে নায়িকা অজ্ঞান হন, আর নায়ক গহনা, টাকা আর ভরসা সব ছিনিয়ে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান।

নড়াইল জেলার কাগজিপাড়া গ্রামের লতা শিকদার (২০), যশোরের ঐতিহ্যবাহী মনিহার সিনেমা হলে পা রেখেছিলেন স্বপ্নের কিছু মুহূর্ত কাটানোর আশায়। কিন্তু প্রেমিকের দেওয়া সেই ‘সারপ্রাইজ’ পরিণত হয় এক দুঃস্বপ্নে।

থ্রিলারের শুরু, বাস্তবতার পরিণতি

প্রেমিক আগেই বলেছিলেন—“আজ তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে!” হয়তো লতা ভেবেছিলেন, একটি আংটি হবে, অথবা হাতে ধরা কিছু গোলাপ। কিন্তু সারপ্রাইজ ছিল ভয়ংকর। সিনেমা চলার মাঝপথে, ঠিক কোন দৃশ্যের সময় লতা অজ্ঞান হন, তা এখনো অজানা। ধারণা করা হচ্ছে, তাকে অজ্ঞান করার জন্য খাওয়ার মধ্যে ওষুধ মেশানো হয় বা স্প্রে ব্যবহার করা হয়।

কিছুক্ষণ পর দর্শকরা লক্ষ্য করেন, এক তরুণী চেয়ারেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছেন। সিনেমা হলের কর্মীরা এগিয়ে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন।

চিকিৎসা ও মানসিক ধাক্কা

চিকিৎসক ডা. মৌসুমি আক্তার জানান, “শারীরিকভাবে এখন তিনি স্থিতিশীল, তবে মানসিকভাবে তিনি এক ধরণের শকের মধ্যে আছেন। বিশ্বাসঘাতকতার ধাক্কা তার মধ্যে গভীরভাবে কাজ করছে।”

লতার সঙ্গে থাকা ব্যাগ, মোবাইল ফোন, গহনা ও নগদ অর্থ সবই নিয়ে গেছে তার ‘প্রেমিক’। এমনকি এখন পর্যন্ত তার পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। কোনো জাতীয় পরিচয়পত্র বা নম্বরও লতার কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

 মাওলানা মুফতি তোফায়েল খান, ইসলামি চিন্তাবিদ ও শেখ বাড়ি মাদরাসার শিক্ষক, বলেন—

“ইসলাম যে সম্পর্ককে স্বীকৃতি দেয় তা হলো বৈধ বিয়ের বন্ধন। অবৈধ সম্পর্ক সবসময়ই বিপদের দরজা খুলে দেয়—শরীরের যেমন ক্ষতি হয়, তেমনি আত্মিক ও সামাজিক ক্ষতিও গভীর হয়। আজ আমরা সমাজে যে প্রেমের নামে প্রতারণা, অজ্ঞান করা, এমনকি সর্বস্ব লুটের ঘটনা দেখছি—তা মূলত আমাদের ধর্মীয় অনুশাসন থেকে দূরে সরে যাওয়ারই ফল।”

“ছেলেমেয়েদের উচিত বৈধ পথ বেছে নেওয়া, পরিবার ও সমাজের অনুমোদিত সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেওয়া। একইসাথে অভিভাবকদেরও দায়িত্ব সন্তানদের যথাযথ ইসলামী শিক্ষা ও সচেতনতা দেওয়া, যাতে তারা আবেগে নয়, বিবেকে পথ চলে। ইসলাম চায় না, একজন তরুণী সিনেমা হলে গিয়ে প্রেমিকের হাতে সর্বস্ব হারাক—ইসলাম চায় সে হোক মর্যাদাপূর্ণ একজন নারী, নিরাপদ সমাজের নাগরিক।”

সামাজিক বাস্তবতা ও প্রেমের ফাঁদ

এই ঘটনার গভীরে রয়েছে সমাজের একটি উদ্বেগজনক বাস্তবতা—অনলাইনে গড়ে ওঠা সম্পর্ক, তড়িঘড়ি বিশ্বাস, আর প্রেমের নামে প্রতারণা। প্রতিদিন সামাজিক মাধ্যমে শত শত সম্পর্ক গড়ে উঠছে, কিন্তু কতজন জানে, অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তি সত্যিই কে?

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের সহকারি অধ্যাপক ডাঃ পলাশ রায় বলেন, তরুণ-তরুণীরা যখন পারিবারিক সম্পর্ক ও সামাজিক সহানুভূতির অভাবে একাকীত্বে ভোগেন, তখন তারা আবেগের জায়গায় নিরাপত্তা খোঁজেন। সেই জায়গাটি খুব সহজেই হয়ে ওঠে প্রতারণার ক্ষেত্র।

সাংবাদিকদের চোখে

সিনিয়র সাংবাদিক কল্লোল আহমেদ বলেন,  এটি নিছক একটি প্রতারণার ঘটনা নয়। এটি একজন নারীর বিশ্বাস, ভালোবাসা ও নিরাপত্তার জায়গায় আঘাত করার একটি চিত্র। যখন একটি মেয়ে তার সামাজিক পরিচয় ভুলে, শুধু বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে কারও সঙ্গে সময় কাটাতে আসেন—তখন এমন আঘাত কেবল শারীরিক নয়, মানসিক এক ধরনের সহিংসতা।

আমরা কী শিখলাম?

এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—

  • প্রেমের নাম করে অনেক অপরাধই সংগঠিত হয়।

  • নারীদের সুরক্ষা শুধু আইনের বিষয় নয়, সামাজিক সচেতনতারও।

  • তরুণ-তরুণীদের উচিত, অনলাইন বা অফলাইন সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু যাচাই-বাছাই করা।

উপসংহার

লতা শিকদারের এই গল্প হয়তো আগামী সপ্তাহে অন্য খবরের নিচে চাপা পড়ে যাবে। কিন্তু তার চোখের শূন্যতা, বিশ্বাসঘাতক প্রেমিকের ফেলে যাওয়া ছায়া আর একাকীত্ব—তা থাকবে তার জীবনে অনেকদিন।

তাকে নিয়ে কেউ হয়তো আর সিনেমা দেখতে যাবে না। কিন্তু তার গল্প হয়তো কাউকে চোখ খুলতে সাহায্য করবে। যেন পরেরবার, কেউ “সারপ্রাইজ আছে” বললে, একটু থেমে, একটু ভেবে নেয়।

লেখক: এস এম মেহেদী হাসান, E-mail : rumeenews@gmail.com, মোবাইল : ০১৭১১ ৯৩ ৪৩ ৫৮

— মিনারা আজমী/ তাবাসসুম/ সালেহ আহমদ