12:31 pm, Sunday, 23 November 2025

পর্তুগালে অভিবাসন নীতির নতুন বাঁক: বন্ধ হচ্ছে ‘প্রশস্ত দরজা’?

পর্তুগালে অভিবাসন নীতির নতুন বাঁক: বন্ধ হচ্ছে ‘প্রশস্ত দরজা’?

লিসবন, পর্তুগাল | ২২ জুলাই ২০২৫ —

এক সময় ইউরোপে অভিবাসীবান্ধব দেশের তালিকায় শীর্ষে থাকা পর্তুগাল এখন অভিবাসন নীতিতে ধারাবাহিকভাবে কঠোর অবস্থান নিচ্ছে। পার্লামেন্টে নতুন অভিবাসন বিধিমালার অনুমোদনের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে যে, দেশটি আর ‘প্রশস্ত-খোলা দরজা’ নীতিতে আগ্রহী নয়।

এই পরিবর্তনের মূল লক্ষ্য—অনিয়মিত অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ, বৈধতার সংজ্ঞা কঠোর করা এবং দেশটির সামাজিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর উপর চাপ কমানো।

কঠোরতার নতুন অধ্যায়

নতুন আইন অনুযায়ী,

  • শুধু উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন অভিবাসীদের কাজের ভিসা দেওয়া হবে

  • পারিবারিক পুনর্মিলনের শর্তাবলী হবে আগের চেয়ে কঠিন

  • ব্রাজিলীয় নাগরিকদের স্বয়ংক্রিয় বসবাস অনুমতির সুবিধা বন্ধ হচ্ছে

  • অনিয়মিত অভিবাসীদের দেশে ফেরত পাঠানো সহজ করতে পুলিশের একটি বিশেষ ইউনিট গঠনের প্রস্তাবও অনুমোদিত হয়েছে

এছাড়া, পর্তুগিজ নাগরিকত্ব অর্জনের নিয়ম কঠোর করার পরিকল্পনাও সংসদে উত্থাপিত হয়েছে, যদিও তা নিয়ে এখনো বিস্তারিত আলোচনা চলছে।

বাতিল হচ্ছে ‘দ্বিতীয় সুযোগ’ নীতি

২০১৮ সালে প্রবর্তিত সেই নীতিটিও বাতিল করা হয়েছে, যার অধীনে পর্যটন ভিসায় আগত কেউ এক বছর কাজের অভিজ্ঞতা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অবদান দেখিয়ে বৈধভাবে বসবাসের অনুমতি পেতে পারতেন। এই সিদ্ধান্তে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বহু দক্ষিণ এশিয়ান অভিবাসী—বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের নাগরিকরা

সংখ্যায় বাড়ছে অভিবাসী, বাড়ছে উদ্বেগ

সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে,

  • ২০১৭ সালের পর থেকে পর্তুগালে অভিবাসীর সংখ্যা চার গুণ বেড়েছে

  • ২০২৪ সালের শেষে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৫০ হাজার, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫%

সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, এই সংখ্যা দেশটির সামাজিক কাঠামো ও সেবা খাতে চাপে ফেলছে, যার ফলেই নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে।

অভিবাসীদের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ

সরকারের একের পর এক কঠোর পদক্ষেপে ইতোমধ্যে ক্ষুব্ধ অভিবাসী সম্প্রদায়।
২০২3 সালের অক্টোবর মাসে লিসবনের পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে হাজারো অভিবাসী বিক্ষোভ করেন।
এতে অংশ নেন বাংলাদেশি অভিবাসীরাও, যারা পারিবারিক পুনর্মিলনের প্রক্রিয়া সহজ করতে বাংলাদেশে পর্তুগিজ দূতাবাস চালুর দাবি জানান।

ডানপন্থায় ঝুঁকছে পর্তুগাল?

পর্যবেক্ষকদের মতে, এই ধারাবাহিক পদক্ষেপগুলো কেবল অভিবাসন নয়, পর্তুগিজ রাজনীতিতে ডানপন্থার শক্তিশালী প্রভাবেরও ইঙ্গিত দেয়।
২০২৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসা প্রধানমন্ত্রী লুইস মন্টিনিগ্রো তার প্রথম ভাষণে বলেন, “অভিবাসন নীতিতে আর উদারতার জায়গা নেই।”
এই অবস্থানই বাস্তবায়িত হচ্ছে একের পর এক আইন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।

উপসংহার: নতুন বাস্তবতা

পর্তুগাল যে এখন আর আগের মতো ‘স্বাগত জানানো দেশ’ নয়, সেটা স্পষ্ট।
বৈধ অভিবাসন প্রক্রিয়াকে সংগঠিত ও দক্ষ করতে চাইছে সরকার, তবে এর সঙ্গে সঙ্গে যেসব অভিবাসী দীর্ঘদিন ধরে পর্তুগালে আছেন, তাঁদের জীবন ও ভবিষ্যত অনিশ্চয়তায় পড়ছে।

বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ান অভিবাসীদের জন্য আগামী দিনগুলো সহজ হবে না—নতুন বাস্তবতায় তাদের হয় আইনগত কাঠামোর ভেতরে আসতে হবে, নয়তো দেশত্যাগের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

— সালেহ/ তাবাসসুম/ মেহেদী

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Popular Post

দ্রব্যমূল্য কমানো ও সর্বস্তরে রেশনিং চালুর দাবি

পর্তুগালে অভিবাসন নীতির নতুন বাঁক: বন্ধ হচ্ছে ‘প্রশস্ত দরজা’?

Update Time : 09:42:42 am, Wednesday, 23 July 2025

পর্তুগালে অভিবাসন নীতির নতুন বাঁক: বন্ধ হচ্ছে ‘প্রশস্ত দরজা’?

লিসবন, পর্তুগাল | ২২ জুলাই ২০২৫ —

এক সময় ইউরোপে অভিবাসীবান্ধব দেশের তালিকায় শীর্ষে থাকা পর্তুগাল এখন অভিবাসন নীতিতে ধারাবাহিকভাবে কঠোর অবস্থান নিচ্ছে। পার্লামেন্টে নতুন অভিবাসন বিধিমালার অনুমোদনের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে যে, দেশটি আর ‘প্রশস্ত-খোলা দরজা’ নীতিতে আগ্রহী নয়।

এই পরিবর্তনের মূল লক্ষ্য—অনিয়মিত অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ, বৈধতার সংজ্ঞা কঠোর করা এবং দেশটির সামাজিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর উপর চাপ কমানো।

কঠোরতার নতুন অধ্যায়

নতুন আইন অনুযায়ী,

  • শুধু উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন অভিবাসীদের কাজের ভিসা দেওয়া হবে

  • পারিবারিক পুনর্মিলনের শর্তাবলী হবে আগের চেয়ে কঠিন

  • ব্রাজিলীয় নাগরিকদের স্বয়ংক্রিয় বসবাস অনুমতির সুবিধা বন্ধ হচ্ছে

  • অনিয়মিত অভিবাসীদের দেশে ফেরত পাঠানো সহজ করতে পুলিশের একটি বিশেষ ইউনিট গঠনের প্রস্তাবও অনুমোদিত হয়েছে

এছাড়া, পর্তুগিজ নাগরিকত্ব অর্জনের নিয়ম কঠোর করার পরিকল্পনাও সংসদে উত্থাপিত হয়েছে, যদিও তা নিয়ে এখনো বিস্তারিত আলোচনা চলছে।

বাতিল হচ্ছে ‘দ্বিতীয় সুযোগ’ নীতি

২০১৮ সালে প্রবর্তিত সেই নীতিটিও বাতিল করা হয়েছে, যার অধীনে পর্যটন ভিসায় আগত কেউ এক বছর কাজের অভিজ্ঞতা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অবদান দেখিয়ে বৈধভাবে বসবাসের অনুমতি পেতে পারতেন। এই সিদ্ধান্তে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বহু দক্ষিণ এশিয়ান অভিবাসী—বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের নাগরিকরা

সংখ্যায় বাড়ছে অভিবাসী, বাড়ছে উদ্বেগ

সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে,

  • ২০১৭ সালের পর থেকে পর্তুগালে অভিবাসীর সংখ্যা চার গুণ বেড়েছে

  • ২০২৪ সালের শেষে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৫০ হাজার, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫%

সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, এই সংখ্যা দেশটির সামাজিক কাঠামো ও সেবা খাতে চাপে ফেলছে, যার ফলেই নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে।

অভিবাসীদের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ

সরকারের একের পর এক কঠোর পদক্ষেপে ইতোমধ্যে ক্ষুব্ধ অভিবাসী সম্প্রদায়।
২০২3 সালের অক্টোবর মাসে লিসবনের পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে হাজারো অভিবাসী বিক্ষোভ করেন।
এতে অংশ নেন বাংলাদেশি অভিবাসীরাও, যারা পারিবারিক পুনর্মিলনের প্রক্রিয়া সহজ করতে বাংলাদেশে পর্তুগিজ দূতাবাস চালুর দাবি জানান।

ডানপন্থায় ঝুঁকছে পর্তুগাল?

পর্যবেক্ষকদের মতে, এই ধারাবাহিক পদক্ষেপগুলো কেবল অভিবাসন নয়, পর্তুগিজ রাজনীতিতে ডানপন্থার শক্তিশালী প্রভাবেরও ইঙ্গিত দেয়।
২০২৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসা প্রধানমন্ত্রী লুইস মন্টিনিগ্রো তার প্রথম ভাষণে বলেন, “অভিবাসন নীতিতে আর উদারতার জায়গা নেই।”
এই অবস্থানই বাস্তবায়িত হচ্ছে একের পর এক আইন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।

উপসংহার: নতুন বাস্তবতা

পর্তুগাল যে এখন আর আগের মতো ‘স্বাগত জানানো দেশ’ নয়, সেটা স্পষ্ট।
বৈধ অভিবাসন প্রক্রিয়াকে সংগঠিত ও দক্ষ করতে চাইছে সরকার, তবে এর সঙ্গে সঙ্গে যেসব অভিবাসী দীর্ঘদিন ধরে পর্তুগালে আছেন, তাঁদের জীবন ও ভবিষ্যত অনিশ্চয়তায় পড়ছে।

বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ান অভিবাসীদের জন্য আগামী দিনগুলো সহজ হবে না—নতুন বাস্তবতায় তাদের হয় আইনগত কাঠামোর ভেতরে আসতে হবে, নয়তো দেশত্যাগের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

— সালেহ/ তাবাসসুম/ মেহেদী