2:14 pm, Sunday, 23 November 2025

দুমকিতে দেশীয় মাছ ও জলজ প্রাণী অস্তিত্ব সংকটে: নিষিদ্ধ জালের অবাধ ব্যবহারেই বিপন্ন জীববৈচিত্র্য

  • Reporter Name
  • Update Time : 05:41:25 pm, Sunday, 20 July 2025
  • 111 Time View

প্রচলিত প্রবাদের বিপরীতে যাচ্ছে বাস্তবতা, প্রশ্ন প্রশাসনের কার্যকারিতা নিয়ে

দুমকি, পটুয়াখালী | ২০ জুলাই ২০২৫ —

“মাছে-ভাতে বাঙালি”—এমন একটি প্রবাদ বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয়, খাদ্যাভ্যাস ও ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি। তবে পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলায় এই ঐতিহ্য আজ গভীর সংকটে। বর্ষা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উপজেলার খাল-বিলগুলোতে নিষিদ্ধ জালের অবাধ ব্যবহার দেশীয় মাছ ও জলজ প্রাণীদের অস্তিত্বের ওপর চরম হুমকি তৈরি করেছে।

প্রাকৃতিক প্রজনন ব্যাহত, হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতি

আঙ্গারিয়া, মোল্লাখালি, বাদ্দার, কচ্ছপিয়া, গাবতলি, দাসপাড়া, কদমতলা, পিছাখালি, জামলা, কোহারজোর, চরবয়ড়া ডাঙ্গা ও শিকদারের খালসহ অন্তত ২০টিরও বেশি জলাশয়ে কারেন্ট জাল, ম্যাজিক জাল, সুতিজাল, বেহুন্দি, ভেসাল এবং চায়না রিং জালের ভয়াবহ বিস্তার দেখা গেছে। স্থানীয় বাজারগুলিতে—নতুন বাজার, পীরতলা, বোর্ড অফিস বাজারসহ বেশ কয়েকটি বাজারে দেশীয় মাছের হাহাকার স্পষ্ট।

এই নিষিদ্ধ জাল ব্যবহারে মাছ ডিম ছাড়ার আগেই ধরা পড়ছে, যার ফলে প্রাকৃতিক প্রজননব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে একসময়ের পরিচিত দেশীয় মাছ—বোয়াল, গজার, শোল, মাগুর, শিং, কই, পাবদা, আইড়, খলসে, বেতাগা, রয়না ও কালিবাউস।

প্রকাশ্যে বিক্রি নিষিদ্ধ জাল, প্রশাসন নির্বিকার?

স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, উপজেলার বাজারগুলোতে প্রকাশ্যে নিষিদ্ধ জালের কেনাবেচা চলছে প্রশাসনের নাকের ডগায়। একাধিক বাজারে এসব জালের অবাধ বিক্রির পেছনে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও দুর্বল নজরদারির অভিযোগ উঠেছে। বৈদ্যুতিক শক ও বর্ষায় দখলদারিত্বের মতো অমানবিক পন্থাও সংকটকে আরও তীব্র করে তুলেছে।

জলজ জীববৈচিত্র্যের উপর চরম হুমকি

শুধু মাছ নয়, এই সংকট জলজ বাস্তুতন্ত্রের অন্যান্য প্রাণীদের—ব্যাঙ, শামুক, জলজ সাপসহ অসংখ্য জীববৈচিত্র্যকেও গ্রাস করছে। শুষ্ক মৌসুমে পুকুর সেচে মাছ আহরণ এবং কৃষিজমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারে পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

প্রশাসনের বক্তব্য ও পদক্ষেপ

এ বিষয়ে দুমকি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মাহফুজুর রহমান বলেন,

“আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। তবে সচেতনতা ও স্থানীয়দের সহযোগিতা ছাড়া এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন।”

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুজর মো. ইজাজুল হক জানান,

“উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আইনানুগ ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে।”

সমাধানের পথ কী?

পরিবেশবিদ ও মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংকট রোধে দরকার তিনটি প্রধান পদক্ষেপ:

  1. নিয়মিত ও কঠোর অভিযানের পাশাপাশি বিকল্প জীবিকায় সহায়তা।
  2. নিষিদ্ধ জাল উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত পদক্ষেপ।
  3. সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

উপসংহার

দুমকির খাল-বিলগুলোর করুণ চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরছে বৃহত্তর বাস্তবতা—অবহেলা, লোভ, এবং প্রশাসনিক শৈথিল্যের ফল কীভাবে একটি অঞ্চল থেকে শতাব্দীর ঐতিহ্য মুছে দিচ্ছে। আজ এই সংকটের বিরুদ্ধে একযোগে রুখে না দাঁড়ালে আগামী প্রজন্ম “মাছে-ভাতে বাঙালি” কথাটিকেই হয়তো ইতিহাস বইয়ে খুঁজবে।

প্রতিবেদক : জাকির হোসেন হাওলাদার

সম্পাদনায় : সুমাইয়া/ তাবাসসুম/ মেহেদী

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Popular Post

দ্রব্যমূল্য কমানো ও সর্বস্তরে রেশনিং চালুর দাবি

দুমকিতে দেশীয় মাছ ও জলজ প্রাণী অস্তিত্ব সংকটে: নিষিদ্ধ জালের অবাধ ব্যবহারেই বিপন্ন জীববৈচিত্র্য

Update Time : 05:41:25 pm, Sunday, 20 July 2025

প্রচলিত প্রবাদের বিপরীতে যাচ্ছে বাস্তবতা, প্রশ্ন প্রশাসনের কার্যকারিতা নিয়ে

দুমকি, পটুয়াখালী | ২০ জুলাই ২০২৫ —

“মাছে-ভাতে বাঙালি”—এমন একটি প্রবাদ বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয়, খাদ্যাভ্যাস ও ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি। তবে পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলায় এই ঐতিহ্য আজ গভীর সংকটে। বর্ষা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উপজেলার খাল-বিলগুলোতে নিষিদ্ধ জালের অবাধ ব্যবহার দেশীয় মাছ ও জলজ প্রাণীদের অস্তিত্বের ওপর চরম হুমকি তৈরি করেছে।

প্রাকৃতিক প্রজনন ব্যাহত, হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতি

আঙ্গারিয়া, মোল্লাখালি, বাদ্দার, কচ্ছপিয়া, গাবতলি, দাসপাড়া, কদমতলা, পিছাখালি, জামলা, কোহারজোর, চরবয়ড়া ডাঙ্গা ও শিকদারের খালসহ অন্তত ২০টিরও বেশি জলাশয়ে কারেন্ট জাল, ম্যাজিক জাল, সুতিজাল, বেহুন্দি, ভেসাল এবং চায়না রিং জালের ভয়াবহ বিস্তার দেখা গেছে। স্থানীয় বাজারগুলিতে—নতুন বাজার, পীরতলা, বোর্ড অফিস বাজারসহ বেশ কয়েকটি বাজারে দেশীয় মাছের হাহাকার স্পষ্ট।

এই নিষিদ্ধ জাল ব্যবহারে মাছ ডিম ছাড়ার আগেই ধরা পড়ছে, যার ফলে প্রাকৃতিক প্রজননব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে একসময়ের পরিচিত দেশীয় মাছ—বোয়াল, গজার, শোল, মাগুর, শিং, কই, পাবদা, আইড়, খলসে, বেতাগা, রয়না ও কালিবাউস।

প্রকাশ্যে বিক্রি নিষিদ্ধ জাল, প্রশাসন নির্বিকার?

স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, উপজেলার বাজারগুলোতে প্রকাশ্যে নিষিদ্ধ জালের কেনাবেচা চলছে প্রশাসনের নাকের ডগায়। একাধিক বাজারে এসব জালের অবাধ বিক্রির পেছনে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও দুর্বল নজরদারির অভিযোগ উঠেছে। বৈদ্যুতিক শক ও বর্ষায় দখলদারিত্বের মতো অমানবিক পন্থাও সংকটকে আরও তীব্র করে তুলেছে।

জলজ জীববৈচিত্র্যের উপর চরম হুমকি

শুধু মাছ নয়, এই সংকট জলজ বাস্তুতন্ত্রের অন্যান্য প্রাণীদের—ব্যাঙ, শামুক, জলজ সাপসহ অসংখ্য জীববৈচিত্র্যকেও গ্রাস করছে। শুষ্ক মৌসুমে পুকুর সেচে মাছ আহরণ এবং কৃষিজমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারে পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

প্রশাসনের বক্তব্য ও পদক্ষেপ

এ বিষয়ে দুমকি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মাহফুজুর রহমান বলেন,

“আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। তবে সচেতনতা ও স্থানীয়দের সহযোগিতা ছাড়া এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন।”

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুজর মো. ইজাজুল হক জানান,

“উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আইনানুগ ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে।”

সমাধানের পথ কী?

পরিবেশবিদ ও মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংকট রোধে দরকার তিনটি প্রধান পদক্ষেপ:

  1. নিয়মিত ও কঠোর অভিযানের পাশাপাশি বিকল্প জীবিকায় সহায়তা।
  2. নিষিদ্ধ জাল উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত পদক্ষেপ।
  3. সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

উপসংহার

দুমকির খাল-বিলগুলোর করুণ চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরছে বৃহত্তর বাস্তবতা—অবহেলা, লোভ, এবং প্রশাসনিক শৈথিল্যের ফল কীভাবে একটি অঞ্চল থেকে শতাব্দীর ঐতিহ্য মুছে দিচ্ছে। আজ এই সংকটের বিরুদ্ধে একযোগে রুখে না দাঁড়ালে আগামী প্রজন্ম “মাছে-ভাতে বাঙালি” কথাটিকেই হয়তো ইতিহাস বইয়ে খুঁজবে।

প্রতিবেদক : জাকির হোসেন হাওলাদার

সম্পাদনায় : সুমাইয়া/ তাবাসসুম/ মেহেদী