লেখক: এস এম মেহেদী হাসান
যশোরের অভয়নগরের পথে-ঘাটে ছায়া দেয় যে তালগাছ, বজ্রপাত থেকে যে গাছগুলো রক্ষা করছে মানুষকে — সেসবের পেছনে লেগে আছে এক অসীম শ্রম আর ভালোবাসার গল্প। গল্পের নায়ক — চিত্তরঞ্জন দাস, যিনি ‘তালগাছ প্রেমিক চিত্ত দা’ নামে সবার কাছে পরিচিত। একাই তিনি রোপণ করেছেন প্রায় তিন লাখ তালগাছ।
তিন বছর বয়সে মায়ের কোলে থাকা শিশুটি বুঝতেই পারেনি মায়ের শূন্যতা কী। আর কৈশোর পেরিয়ে যুবক বয়সে বাবাকে হারানো চিত্তরঞ্জন পিতার শেখানো একটি শিক্ষাই আঁকড়ে ধরেছিলেন — তালগাছ লাগাও, বজ্রপাত ঠেকাও। আমেরিকার এক বিজ্ঞানীর বক্তব্যে প্রেরণা খুঁজে নিয়ে নিজের অভাবী সংসার সামলে সারাজীবন ব্যয় করেছেন তালবীজ বুনে আর পরিচর্যা করে।
চিত্ত দার জীবনের গল্প আজ শুধু এক ব্যক্তির গল্প নয় — এটি এক অদম্য প্রাণশক্তি আর পরিবেশ রক্ষার অনন্য উদাহরণ।
তালগাছের অগাধ উপকারিতা
বিশেষজ্ঞদের মতে, তালগাছের উপকারিতা বহুমাত্রিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন,
“তালগাছ বজ্রনিরোধক হিসেবে প্রমাণিত। উঁচু তালগাছ বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গের প্রাকৃতিক রোধক হিসেবে কাজ করে। গ্রামীণ অঞ্চলে তালগাছ বেশি থাকলে বজ্রপাতে মৃত্যু হার কমে যায়। একই সঙ্গে তালগাছ ভূমিক্ষয় রোধে, বায়ুপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে ও পরিবেশের শীতলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।”
শুধু বজ্রপাত প্রতিরোধ নয় — তালগাছ আমাদের মিষ্টি ফলের জোগান দেয়। তালের রস, তালশাঁস, পাটালি, তালের পিঠা, তালপাখা — গ্রামীণ বাংলার সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তালের পাতা ও গাছ কাঠও উপকারী।
কেন বেশি করে তালগাছ লাগাতে হবে?
বাংলাদেশ বজ্রপাতপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তথ্য মতে, প্রতিবছর গড়ে ২০০-৩০০ জন বজ্রপাতে মারা যান। এই মৃত্যু হার কমাতে দেশজুড়ে তালগাছ রোপণের উদ্যোগকে জোরদার করা জরুরি। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা ও সবুজ ঢাকা বিস্তৃত করতে তালগাছের বিকল্প নেই।
একাই তিন লাখ গাছ: স্থানীয়দের চোখে চিত্ত দা
চিত্তরঞ্জন দাসের গ্রামেরই বাসিন্দা ইব্রাহিম হোসেন বলেন,
“চিত্ত দা সারা বছর তালবীজের পেছনে ঘুরে বেড়ান। কেউ যদি তার লাগানো গাছের নিচে একটু ছায়া নেয়, তাতেই তিনি খুশি।”
উপজেলার বহু কৃষক জানান, মাঠে কাজের ফাঁকে তালগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ক্লান্তি দূর হয়। কেউ কেউ বলেন, চিত্তরঞ্জনের গাছগুলো এখন এলাকার গর্ব।
বন বিভাগের দৃষ্টিতে এই উদ্যোগ
অভয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কে এম আবু নওশাদ বলেন,
“চিত্তরঞ্জন দাস একাই যে কাজ করছেন, তা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের সমান। এই প্রচেষ্টা দেশের অন্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে দিতে হবে। বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসন তার পাশে আছে।”
সমস্যা ও সম্ভাবনা
তবে চিত্তরঞ্জনের এই মহৎ প্রচেষ্টা কিছু সমস্যার মুখে পড়ছে। গাছের পাতা কেটে হাতপাখা বানানো, চারার ক্ষতি করা, জলাবদ্ধতায় গাছ মারা যাওয়া — এসবই বড় চ্যালেঞ্জ। প্রয়োজন যথাযথ তদারকি ও স্থানীয়দের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলা।
চিত্তরঞ্জন দাস আশা করেন, তার মৃত্যুর পরও কেউ যেন তার গাছগুলোর যত্ন নেন — বজ্রনিরোধক সবুজ বর্মটিকে বাঁচিয়ে রাখেন।
শেষ কথা
তালগাছ শুধু একটি গাছ নয় — এটি একটুকু ছায়া, একটি বজ্রনিরোধক বর্ম আর আমাদের লোকজ জীবনের স্বাদ। আর চিত্ত দা প্রমাণ করছেন, ইচ্ছা থাকলে একাই বদলে দেওয়া যায় একেকটি গ্রাম, একেকটি জনপদ। তার হাতে লাগানো তালগাছের সারি হয়ে উঠুক বাংলাদেশজুড়ে বজ্রনিরোধক সবুজ দেয়াল।
রূপান্তর সংবাদ-এ প্রতিনিধি হোন!
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে। আগ্রহীরা সিভি পাঠান: E-mail : rupantorsongbad@gmail.com
লেখক পরিচিতি
এস এম মেহেদী হাসান — সাংবাদিক ও ফিচার লেখক। পরিবেশ, গ্রামীণ জীবন, উন্নয়ন এবং মানবিক গল্প নিয়ে লিখতে ভালোবাসেন। দেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় ও অনলাইন মাধ্যমে তার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। লেখার মাধ্যমে মানুষের অজানা গল্প তুলে ধরাই তার প্রধান লক্ষ্য।
সম্পাদনায় : সুমাইয়া/ তাবাসসুম/ মাহমুদুল
Reporter Name 



























