লেখক : এস এম মেহেদী হাসান
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার বুকে লুকিয়ে থাকা হাজারিখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য (Hazarikhil Wildlife Sanctuary) শুধু বাংলাদেশের নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সুন্দর প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ও পাখির স্বর্গভূমি। যারা প্রকৃতি আর বন্যপ্রাণের সান্নিধ্যে কয়েকটা দিন কাটাতে চান, তাদের জন্য এর চেয়ে আদর্শ গন্তব্য খুব কমই আছে।
অবস্থান ও ইতিহাস
১৮৯৩ সালে ‘রামগড়-সীতাকুণ্ড সংরক্ষিত বন’ (Ramgarh-Sitakunda Reserve Forest) হিসেবে ঘোষিত এই অঞ্চলকে সরকার ২০১০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা করে। প্রায় ২,৯০৮ হেক্টর পাহাড়ি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই বন প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের এক অনন্য ভাণ্ডার।
জীববৈচিত্র্যের রাজ্য
হাজারিখিলে দেখা মেলে নানা বিরল বন্যপ্রাণীর:
- ভাল্লুক (Bear)
- বনবিড়াল (Jungle Cat)
- মেছোবাঘ (Fishing Cat)
- শিয়াল (Fox)
- মায়া হরিণ (Barking Deer)
- সাম্বার হরিণ (Sambar Deer)
- বন কুকুর (Wild Dog)
- বনছাগল (Serow)
- বানর ও হনুমান (Monkey & Langur)
মাঝে মাঝে ভাগ্যবান হলে চিতাবাঘ (Leopard) দেখার সৌভাগ্যও হতে পারে।
এছাড়া আছে ৮ প্রজাতির উভচর (Amphibians) আর ২৫ প্রজাতির সরীসৃপ (Reptiles)। তবে হাজারিখিলের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এর পাখির জগত — এখানে প্রায় ১২৩ প্রজাতির পাখি দেখা গেছে।
বিপন্নপ্রায় কাঠময়ূর (Great Hornbill) ও মথুরা (Hill Myna)-এর মতো পাখি এখানে পাওয়া যায়। আছে কাউ ধনেশ (Oriental Pied Hornbill), হুতুম পেঁচা (Spotted Owlet), হুদহুদ (Hoopoe), চোখ গেল (Asian Paradise Flycatcher), নীলকান্ত (Kingfisher), বেঘবৌ (Green Bee-eater), আবাবিল (Swallow) প্রভৃতি।
অভিযান ও ট্রেকিং
বনে ঘুরতে গেলে পাড়ি দিতে হয় চা বাগানঘেরা মেঠোপথ, ঝিরিপথ আর পাথুরে ট্রেইল।
‘বনমানুষের গুহা’ (Ape’s Cave) ও ‘ভাণ্ডারিয়া ঝরনা’ (Vandaraiya Waterfall) এই অঞ্চলের বিশেষ আকর্ষণ।
ঝরনার জলাশয়ে স্নান করে প্রাকৃতিক মায়ায় মোড়ানো পরিবেশে বিশ্রাম নেয়া যেতে পারে। এরপর শুরু করতে পারেন পাহাড়চূড়া বেয়ে চ্যালেঞ্জিং ট্রেকিং। পথ খাড়াই ও পিচ্ছিল হওয়ায় চারপাশে জোঁকের উপস্থিতি থাকে, তাই সতর্কতার সহিত চলতে হবে।
পরিবেশ রক্ষার আহ্বান
অভয়ারণ্যে ট্রেকিং বা পিকনিক করতে গিয়ে কেউ কেউ আবর্জনা, বিশেষ করে পলিথিন ফেলে যাচ্ছেন — যা এই অনন্য পরিবেশের জন্য ভয়ংকর ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই এই সবুজ স্বর্গভূমিকে রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সরাসরি বিমানযোগে চট্টগ্রাম (প্রায় ৪৫ মিনিট)। সেখান থেকে ফটিকছড়ি উপজেলার দূরত্ব প্রায় ৬০-৭০ কিলোমিটার (প্রায় ২ ঘণ্টা গাড়ি যাত্রা)। শহর থেকে রিজার্ভ সিএনজি বা মাইক্রোবাসে সরাসরি ‘হাজারিখিল ইকো ট্যুরিজম অফিস’ পর্যন্ত যাওয়া যায়। দল বড় হলে রেন্ট-এ-কারই উত্তম।
কোথায় থাকবেন
বিদেশি পর্যটকদের জন্য কয়েকটি নির্ভরযোগ্য রিসোর্ট ও হোটেল:
- Forest Eco Cottage – Hazarikhil
- Hillview Resort – Fatikchhari
- Chittagong City Hotel (যদি শহরে রাত কাটান)
অভয়ারণ্যের ভেতরে বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে তাঁবু টানানো বা ক্যাম্পিংয়ের সুযোগও আছে। স্থানীয় গাইড অবশ্যই সঙ্গে রাখা উচিত, কারণ অজানা ট্রেইল ও নিরাপত্তার জন্য স্থানীয়রাই সবচেয়ে ভালো সহায়।
যোগাযোগ
পর্যটকদের জন্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ:
- বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম: +৮৮-০২৪১৩৮০৭০১ (অফিস), +৮৮০১৭১১২৪২৬৭৫ (মোবাইল)
- ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা: ০২৩৩-৪৪৫৭১৬৬ (অফিস), ০১৭৩৩-৩৩৪৩৪৮ (মোবাইল)
- ফটিকছড়ি থানার অফিসার ইনচার্জ: ফোন (অফিস) : ০৩০২২-৫৬০০১, ০১৭১৩-৩৭৩৬৪১ (মোবাইল)
- সীতাকুণ্ড থানার অফিসার ইনচার্জ: ০৩০২৮৫৬১০৩ (অফিস), ০১৩২০-১০৭৪৯৬ (মোবাইল)
শেষ কথা
হাজারিখিল শুধু একখণ্ড বন নয় — এটি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বন্ধনের এক অনন্য নিদর্শন। এখানে আসুন, পাখির কোলাহলে হারিয়ে যান — আর ফিরে যাওয়ার আগে এই বনের প্রতিটি গাছ, পাখি ও জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করার অঙ্গীকার করুন।
লেখক পরিচিতি
এস. এম. মেহেদী হাসান একজন ভ্রমণলেখক ও সাংবাদিক। দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে লেখালেখি করেন নিয়মিত।
Reporter Name 



























