1:00 pm, Sunday, 23 November 2025

ছেলের বাধায় নিজ ঘরে ফিরতে পারছেন না মা

  • Reporter Name
  • Update Time : 05:43:18 am, Tuesday, 15 July 2025
  • 23 Time View

স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত ঘরেও ঠাঁই নেই বৃদ্ধা বিলকিস আক্তারের

নওগাঁ | ১৫ জুলাই ২০২৫ —

নিজের ঘরেও অনাহূত মা
নওগাঁ শহরের কাজীর মোড়ে স্বামীর রেখে যাওয়া বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করেও পাঁচ ঘণ্টা গেটের সামনে বসে থাকতে হলো ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধা বিলকিস আক্তারকে। ছেলে মোস্তাফিজুল ইসলাম সৌরভের বাধার মুখে শেষ পর্যন্ত নিজ ঘরেই ফিরতে পারলেন না তিনি।

স্মৃতি আর অশ্রুতে গৃহপ্রবেশের চেষ্টা
সোমবার (১৪ জুলাই) দুপুর ১১টায় স্বামীর পুরনো বাড়ির দ্বিতীয় তলায় নিজের কক্ষে উঠতে গিয়ে দেখেন, সিঁড়ির মুখে লোহার গেট বন্ধ, তালা ঝুলছে। ছেলেকে ফোন করলে সাফ জবাব— ‘মাকে আর ঢুকতে দেব না।’

বিলকিস আক্তার গেটের সামনের গ্যারেজে বসে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেন, “আমি রোজা রেখেছি। সকাল থেকে বসে আছি, তবু ঢুকতে পারছি না। ছেলে বলে— ‘তুই দুই আনার মালিক, তুই গিয়ে পাথারে থাক।’”

মেয়েদের অংশ লিখেও কোনো লাভ হয়নি
বিলকিস আক্তার জানান, অপমান সহ্য করতে না পেরে তার মেয়েরা নিজেদের অংশ মায়ের নামে লিখে দিয়েছে। এখন দলিলপত্র অনুযায়ী বাড়ির প্রায় ৭০ শতাংশের মালিক তিনি একাই। তবু তার নিজের ঘরে ঢোকার অধিকার নেই।

অতীতেও নির্যাতন ও মামলা
বড় মেয়ের স্বামী ডা. আবুজার গাফফার বলেন, “আমার শ্যালক নিজের মাকে আগেও মারধর করেছে, মামলাও হয়েছে। পরে আমার স্ত্রী আর শালিকা তাদের অংশ মায়ের নামে লিখে দেয়।”

তবে ছেলে মোস্তাফিজুল ইসলাম সৌরভ বলেন, পারিবারিক বিরোধ থেকে মারামারি, চাঁদাবাজি ও হুমকি সংক্রান্ত মামলার কারণে আদালতের নির্দেশে তার মা এখন বড় মেয়ের জিম্মায় আছেন। “মা থাকলে আবারও সংঘর্ষ হতে পারে,” দাবি করেন তিনি।

আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে

অ্যাডভোকেট জাকির হোসেন ভুঁইয়া বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি তার বৈধ সম্পত্তির অধিকার থেকে কোনোভাবে বঞ্চিত হতে পারেন না। বিলকিস আক্তার যদি দলিল অনুযায়ী বাড়ির ৭০% এর মালিকানা পেয়ে থাকেন, তবে তার ছেলে কোনোভাবেই তাকে সেই বাড়িতে প্রবেশে বাধা দিতে পারে না।

পারিবারিক বিরোধ থাকলেও সেটি আইনি প্রক্রিয়ায় সমাধানযোগ্য, গৃহে প্রবেশের অধিকার হরণ করার কোনো এখতিয়ার ছেলের নেই। যদি কোনো আদালতের আদেশ থাকে যে তিনি বড় মেয়ের জিম্মায় থাকবেন, তবুও তা সম্পত্তিতে প্রবেশাধিকার রোধ করতে পারে না, যদি না তা স্পষ্টভাবে আদালতের রায়ে উল্লেখ থাকে।

তাই বিলকিস আক্তার আইনের আশ্রয় নিয়ে সহজেই তার বৈধ অধিকার ফিরে পেতে পারেন। প্রয়োজনে আদালতের মাধ্যমে অবিলম্বে বাড়িতে প্রবেশের নির্দেশনা আদায় করা সম্ভব।

ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে

মিশকাতুল কোরআন মাদরাসার মোহতামিম মাওলানা শেখ সাদ আহমদ আমিন বর্ণভী বলেন, ইসলামে মায়ের মর্যাদা পৃথিবীর সব চেয়ে উঁচুতে। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমার মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।’ একজন মুসলিম সন্তানের জন্য মায়ের সেবা করা ফরজ। নিজের স্বার্থের জন্য মাকে গৃহচ্যুত করা মহাপাপ ও বড় গুনাহ।

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে— ‘তোমরা তোমাদের পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করো, তাদের কোনো ক্ষতি করো না।’ (সূরা বনি ইসরাইল: ২৩)। মা যতটুকুই মালিক হোক, সেটা বড় কথা নয়; মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালনই সন্তানদের জন্য সবচেয়ে বড় আমানত।

তাই ছেলের উচিত মায়ের জন্য ঘরের দরজা খুলে দেওয়া, তার খাদ্য-বস্ত্র, বাসস্থান ও নিরাপত্তার দায়িত্ব বহন করা। ইসলামে পিতা-মাতাকে কষ্ট দেওয়া কবিরা গুনাহ, এ গুনাহ করলে আল্লাহর কঠিন শাস্তির ভয় আছে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে মায়ের হক আদায় করার তৌফিক দিন।

মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে

সিনিয়র সাংবাদিক এস এম মেহেদী হাসান বলেন, একজন মা, যিনি জীবনে সন্তানপালন করেছেন, বার্ধক্যে তার নিজের ঘরেও ঠাঁই না পাওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। সমাজ ও প্রশাসনের উচিত তার পাশে দাঁড়ানো, যাতে মা ঘরে ফিরতে পারেন এবং শান্তিতে শেষ জীবন যাপন করতে পারেন। এটি মানবিকতা ও সভ্যতার মাপকাঠি।

শেষ ইচ্ছা অনিশ্চিত
বিলকিস আক্তার চান, স্বামীর স্মৃতি বিজড়িত এই ঘরেই শেষ বয়সটা কাটাতে। কিন্তু পরিবারের টানাপোড়েনে সেই চাওয়াই এখন সবচেয়ে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রূপান্তর সংবাদ-এ প্রতিনিধি হোন!
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে। আগ্রহীরা সিভি পাঠান: E-mail : rupantorsongbad@gmail.com

প্রতিবেদক : মাহমুদুল হাসান

সম্পাদনায় : সুমাইয়া/ তাবাসসুম/ মেহেদী

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Popular Post

দ্রব্যমূল্য কমানো ও সর্বস্তরে রেশনিং চালুর দাবি

ছেলের বাধায় নিজ ঘরে ফিরতে পারছেন না মা

Update Time : 05:43:18 am, Tuesday, 15 July 2025

স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত ঘরেও ঠাঁই নেই বৃদ্ধা বিলকিস আক্তারের

নওগাঁ | ১৫ জুলাই ২০২৫ —

নিজের ঘরেও অনাহূত মা
নওগাঁ শহরের কাজীর মোড়ে স্বামীর রেখে যাওয়া বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করেও পাঁচ ঘণ্টা গেটের সামনে বসে থাকতে হলো ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধা বিলকিস আক্তারকে। ছেলে মোস্তাফিজুল ইসলাম সৌরভের বাধার মুখে শেষ পর্যন্ত নিজ ঘরেই ফিরতে পারলেন না তিনি।

স্মৃতি আর অশ্রুতে গৃহপ্রবেশের চেষ্টা
সোমবার (১৪ জুলাই) দুপুর ১১টায় স্বামীর পুরনো বাড়ির দ্বিতীয় তলায় নিজের কক্ষে উঠতে গিয়ে দেখেন, সিঁড়ির মুখে লোহার গেট বন্ধ, তালা ঝুলছে। ছেলেকে ফোন করলে সাফ জবাব— ‘মাকে আর ঢুকতে দেব না।’

বিলকিস আক্তার গেটের সামনের গ্যারেজে বসে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেন, “আমি রোজা রেখেছি। সকাল থেকে বসে আছি, তবু ঢুকতে পারছি না। ছেলে বলে— ‘তুই দুই আনার মালিক, তুই গিয়ে পাথারে থাক।’”

মেয়েদের অংশ লিখেও কোনো লাভ হয়নি
বিলকিস আক্তার জানান, অপমান সহ্য করতে না পেরে তার মেয়েরা নিজেদের অংশ মায়ের নামে লিখে দিয়েছে। এখন দলিলপত্র অনুযায়ী বাড়ির প্রায় ৭০ শতাংশের মালিক তিনি একাই। তবু তার নিজের ঘরে ঢোকার অধিকার নেই।

অতীতেও নির্যাতন ও মামলা
বড় মেয়ের স্বামী ডা. আবুজার গাফফার বলেন, “আমার শ্যালক নিজের মাকে আগেও মারধর করেছে, মামলাও হয়েছে। পরে আমার স্ত্রী আর শালিকা তাদের অংশ মায়ের নামে লিখে দেয়।”

তবে ছেলে মোস্তাফিজুল ইসলাম সৌরভ বলেন, পারিবারিক বিরোধ থেকে মারামারি, চাঁদাবাজি ও হুমকি সংক্রান্ত মামলার কারণে আদালতের নির্দেশে তার মা এখন বড় মেয়ের জিম্মায় আছেন। “মা থাকলে আবারও সংঘর্ষ হতে পারে,” দাবি করেন তিনি।

আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে

অ্যাডভোকেট জাকির হোসেন ভুঁইয়া বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি তার বৈধ সম্পত্তির অধিকার থেকে কোনোভাবে বঞ্চিত হতে পারেন না। বিলকিস আক্তার যদি দলিল অনুযায়ী বাড়ির ৭০% এর মালিকানা পেয়ে থাকেন, তবে তার ছেলে কোনোভাবেই তাকে সেই বাড়িতে প্রবেশে বাধা দিতে পারে না।

পারিবারিক বিরোধ থাকলেও সেটি আইনি প্রক্রিয়ায় সমাধানযোগ্য, গৃহে প্রবেশের অধিকার হরণ করার কোনো এখতিয়ার ছেলের নেই। যদি কোনো আদালতের আদেশ থাকে যে তিনি বড় মেয়ের জিম্মায় থাকবেন, তবুও তা সম্পত্তিতে প্রবেশাধিকার রোধ করতে পারে না, যদি না তা স্পষ্টভাবে আদালতের রায়ে উল্লেখ থাকে।

তাই বিলকিস আক্তার আইনের আশ্রয় নিয়ে সহজেই তার বৈধ অধিকার ফিরে পেতে পারেন। প্রয়োজনে আদালতের মাধ্যমে অবিলম্বে বাড়িতে প্রবেশের নির্দেশনা আদায় করা সম্ভব।

ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে

মিশকাতুল কোরআন মাদরাসার মোহতামিম মাওলানা শেখ সাদ আহমদ আমিন বর্ণভী বলেন, ইসলামে মায়ের মর্যাদা পৃথিবীর সব চেয়ে উঁচুতে। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমার মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।’ একজন মুসলিম সন্তানের জন্য মায়ের সেবা করা ফরজ। নিজের স্বার্থের জন্য মাকে গৃহচ্যুত করা মহাপাপ ও বড় গুনাহ।

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে— ‘তোমরা তোমাদের পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করো, তাদের কোনো ক্ষতি করো না।’ (সূরা বনি ইসরাইল: ২৩)। মা যতটুকুই মালিক হোক, সেটা বড় কথা নয়; মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালনই সন্তানদের জন্য সবচেয়ে বড় আমানত।

তাই ছেলের উচিত মায়ের জন্য ঘরের দরজা খুলে দেওয়া, তার খাদ্য-বস্ত্র, বাসস্থান ও নিরাপত্তার দায়িত্ব বহন করা। ইসলামে পিতা-মাতাকে কষ্ট দেওয়া কবিরা গুনাহ, এ গুনাহ করলে আল্লাহর কঠিন শাস্তির ভয় আছে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে মায়ের হক আদায় করার তৌফিক দিন।

মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে

সিনিয়র সাংবাদিক এস এম মেহেদী হাসান বলেন, একজন মা, যিনি জীবনে সন্তানপালন করেছেন, বার্ধক্যে তার নিজের ঘরেও ঠাঁই না পাওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। সমাজ ও প্রশাসনের উচিত তার পাশে দাঁড়ানো, যাতে মা ঘরে ফিরতে পারেন এবং শান্তিতে শেষ জীবন যাপন করতে পারেন। এটি মানবিকতা ও সভ্যতার মাপকাঠি।

শেষ ইচ্ছা অনিশ্চিত
বিলকিস আক্তার চান, স্বামীর স্মৃতি বিজড়িত এই ঘরেই শেষ বয়সটা কাটাতে। কিন্তু পরিবারের টানাপোড়েনে সেই চাওয়াই এখন সবচেয়ে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রূপান্তর সংবাদ-এ প্রতিনিধি হোন!
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে। আগ্রহীরা সিভি পাঠান: E-mail : rupantorsongbad@gmail.com

প্রতিবেদক : মাহমুদুল হাসান

সম্পাদনায় : সুমাইয়া/ তাবাসসুম/ মেহেদী