1:02 pm, Sunday, 23 November 2025

গোবিন্দগঞ্জে মাদকবিরোধী অভিযান: ইসলামী দৃষ্টিকোণ, আইন ও সমাজের চ্যালেঞ্জ

  • Reporter Name
  • Update Time : 06:15:57 pm, Friday, 11 July 2025
  • 19 Time View

গাইবান্ধা | ১১ জুলাই ২০২৫ —

বাংলাদেশে মাদক সমস্যা নতুন নয়। তবে মাদকের বিস্তার যে হারে গ্রাম-গঞ্জ থেকে শহর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে, তা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য এক বড় সংকেত। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানেই কি এই দুষ্টচক্র ভাঙা সম্ভব? না কি দরকার ইসলামি মূল্যবোধ, কঠোর আইন প্রয়োগ আর সামাজিক সচেতনতার সমন্বিত প্রয়োগ?
সম্প্রতি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে যৌথ বাহিনীর সফল অভিযান আবারও মনে করিয়ে দিয়েছে— মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই শুধু পুলিশের নয়, পুরো সমাজের।

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের মালমঞ্চা গ্রামে যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযানে ১৮০ পিস নেশাজাতীয় ট্যাবলেট ট্যাফেন্টাডল, ছয়টি দেশীয় অস্ত্র, দুটি মোবাইল ফোন এবং একটি জাল পাঁচশ টাকার নোটসহ চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী বাহাদুর সরকারকে আটক করা হয়েছে।

গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে গাইবান্ধা সেনা ক্যাম্পের মেজর ইনজামামুল আলমের নেতৃত্বে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এই অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযান চলে পুরো রাতজুড়ে। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, আটক হওয়া বাহাদুর সরকার দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল।

অভিযান শেষে গোবিন্দগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বুলবুল ইসলাম জানান, “আটক বাহাদুর সরকারের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ এর অধীনে মামলা রুজু করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় আইনগত প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।”

ইসলামে মাদক: পাপ ও বিপর্যয়

মাদক প্রসঙ্গে ইসলামি বিধান অত্যন্ত স্পষ্ট। মিশকাতুল কোরআন মাদরাসার মোহতামিম শেখ সাদ আহমদ আমিন বর্ণভী বলেন, “মাদকদ্রব্য, হোক তা মদ বা যেকোনো নেশার জিনিস — সবই কুরআন ও হাদিসে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। মাদককে বলা হয় ‘উম্মুল খাবায়েস’, অর্থাৎ সব অশুভের মূল। একজন মুসলিম হিসেবে মাদক উৎপাদন, বিক্রি ও সেবন সবই হারাম। আমাদের সমাজে ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিকতা জাগ্রত না হলে আইন দিয়ে সব ঠেকানো সম্ভব নয়।”

আইন: শাস্তি আছে, প্রয়োগ দুর্বল

দেশে মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর আইন থাকলেও বাস্তবে এর কার্যকারিতা নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট মো. রেজাউল করিম বলেন, “মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ অনুযায়ী ট্যাফেন্টাডল জাতীয় নেশাদ্রব্যের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু বড় চক্রগুলোর সঙ্গে প্রভাবশালী দালাল ও দুর্নীতির কারণে মূল হোতারা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই আইনের কঠোর প্রয়োগের সঙ্গে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়াতে হবে। সেনাবাহিনীর এই ধরনের যৌথ অভিযান সমাজে বার্তা দেয় যে অপরাধী যতই শক্তিশালী হোক, আইনের চোখ ফাঁকি দিতে পারবে না।”

বিশেষজ্ঞের পরামর্শ: চিকিৎসা ও পুনর্বাসন জরুরি

মাদক সমস্যা কেবল আইনশৃঙ্খলা ইস্যু নয় — এটি মানসিক ও সামাজিক রোগ। মাদকাসক্তি নিরাময় বিশেষজ্ঞ ডা. শামসুন নাহার বলেন,
“ট্যাফেন্টাডলের মতো নেশাজাতীয় ট্যাবলেট কিশোর-তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে ভয়াবহ হারে। একবার আসক্ত হলে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা কঠিন হয়। তাই অভিযানের পাশাপাশি আসক্তদের চিকিৎসা, কাউন্সেলিং ও পুনর্বাসন সেবা নিশ্চিত করতে হবে। পরিবারকে আরও সচেতন হতে হবে। স্কুল, মসজিদ, মাদরাসা ও গণমাধ্যম— সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে।”

সমাজের চ্যালেঞ্জ: শুধু অভিযান নয়, সামাজিক আন্দোলন দরকার

গোবিন্দগঞ্জের সফল অভিযান দেখিয়েছে, গোপন তথ্য, যৌথ বাহিনীর সমন্বিত পদক্ষেপ ও দ্রুত আইনি ব্যবস্থা— এই তিনটি মিলেই ফল আসে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়: আগামী প্রজন্মকে মাদকমুক্ত রাখতে পারি তো? ইসলামি নৈতিকতা, কঠোর আইন প্রয়োগ, স্বাস্থ্যসেবা এবং সচেতনতা — এই চারটি স্তম্ভ ছাড়া মাদকমুক্ত সমাজ গড়া কঠিনই বটে।

উপসংহার

গোবিন্দগঞ্জের এই ঘটনা যেমন আবারও প্রমাণ করেছে— মাদক চক্র যতই শক্তিশালী হোক, সঠিক পদক্ষেপ নিলে ধরা পড়বেই। তেমনি এটিও মনে করিয়ে দিচ্ছে— শুধু পুলিশি অভিযান নয়, পুরো সমাজকেই জেগে উঠতে হবে। ধর্মীয় মূল্যবোধ, পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আইনের কঠোর প্রয়োগ— এই সবই একসাথে না চললে মাদকমুক্ত বাংলাদেশ স্বপ্নই থেকে যাবে।

রূপান্তর সংবাদ-এ প্রতিনিধি হোন!
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে। আগ্রহীরা সিভি পাঠান: E-mail : rupantorsongbad@gmail.com

প্রতিবেদক : মাহমুদুল হাসান

সম্পাদনায় : সুমাইয়া ইসলাম/ তাবাসসুম/ মাহমুদুল

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Popular Post

দ্রব্যমূল্য কমানো ও সর্বস্তরে রেশনিং চালুর দাবি

গোবিন্দগঞ্জে মাদকবিরোধী অভিযান: ইসলামী দৃষ্টিকোণ, আইন ও সমাজের চ্যালেঞ্জ

Update Time : 06:15:57 pm, Friday, 11 July 2025

গাইবান্ধা | ১১ জুলাই ২০২৫ —

বাংলাদেশে মাদক সমস্যা নতুন নয়। তবে মাদকের বিস্তার যে হারে গ্রাম-গঞ্জ থেকে শহর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে, তা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য এক বড় সংকেত। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানেই কি এই দুষ্টচক্র ভাঙা সম্ভব? না কি দরকার ইসলামি মূল্যবোধ, কঠোর আইন প্রয়োগ আর সামাজিক সচেতনতার সমন্বিত প্রয়োগ?
সম্প্রতি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে যৌথ বাহিনীর সফল অভিযান আবারও মনে করিয়ে দিয়েছে— মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই শুধু পুলিশের নয়, পুরো সমাজের।

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের মালমঞ্চা গ্রামে যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযানে ১৮০ পিস নেশাজাতীয় ট্যাবলেট ট্যাফেন্টাডল, ছয়টি দেশীয় অস্ত্র, দুটি মোবাইল ফোন এবং একটি জাল পাঁচশ টাকার নোটসহ চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী বাহাদুর সরকারকে আটক করা হয়েছে।

গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে গাইবান্ধা সেনা ক্যাম্পের মেজর ইনজামামুল আলমের নেতৃত্বে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এই অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযান চলে পুরো রাতজুড়ে। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, আটক হওয়া বাহাদুর সরকার দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল।

অভিযান শেষে গোবিন্দগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বুলবুল ইসলাম জানান, “আটক বাহাদুর সরকারের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ এর অধীনে মামলা রুজু করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় আইনগত প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।”

ইসলামে মাদক: পাপ ও বিপর্যয়

মাদক প্রসঙ্গে ইসলামি বিধান অত্যন্ত স্পষ্ট। মিশকাতুল কোরআন মাদরাসার মোহতামিম শেখ সাদ আহমদ আমিন বর্ণভী বলেন, “মাদকদ্রব্য, হোক তা মদ বা যেকোনো নেশার জিনিস — সবই কুরআন ও হাদিসে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। মাদককে বলা হয় ‘উম্মুল খাবায়েস’, অর্থাৎ সব অশুভের মূল। একজন মুসলিম হিসেবে মাদক উৎপাদন, বিক্রি ও সেবন সবই হারাম। আমাদের সমাজে ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিকতা জাগ্রত না হলে আইন দিয়ে সব ঠেকানো সম্ভব নয়।”

আইন: শাস্তি আছে, প্রয়োগ দুর্বল

দেশে মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর আইন থাকলেও বাস্তবে এর কার্যকারিতা নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট মো. রেজাউল করিম বলেন, “মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ অনুযায়ী ট্যাফেন্টাডল জাতীয় নেশাদ্রব্যের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু বড় চক্রগুলোর সঙ্গে প্রভাবশালী দালাল ও দুর্নীতির কারণে মূল হোতারা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই আইনের কঠোর প্রয়োগের সঙ্গে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়াতে হবে। সেনাবাহিনীর এই ধরনের যৌথ অভিযান সমাজে বার্তা দেয় যে অপরাধী যতই শক্তিশালী হোক, আইনের চোখ ফাঁকি দিতে পারবে না।”

বিশেষজ্ঞের পরামর্শ: চিকিৎসা ও পুনর্বাসন জরুরি

মাদক সমস্যা কেবল আইনশৃঙ্খলা ইস্যু নয় — এটি মানসিক ও সামাজিক রোগ। মাদকাসক্তি নিরাময় বিশেষজ্ঞ ডা. শামসুন নাহার বলেন,
“ট্যাফেন্টাডলের মতো নেশাজাতীয় ট্যাবলেট কিশোর-তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে ভয়াবহ হারে। একবার আসক্ত হলে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা কঠিন হয়। তাই অভিযানের পাশাপাশি আসক্তদের চিকিৎসা, কাউন্সেলিং ও পুনর্বাসন সেবা নিশ্চিত করতে হবে। পরিবারকে আরও সচেতন হতে হবে। স্কুল, মসজিদ, মাদরাসা ও গণমাধ্যম— সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে।”

সমাজের চ্যালেঞ্জ: শুধু অভিযান নয়, সামাজিক আন্দোলন দরকার

গোবিন্দগঞ্জের সফল অভিযান দেখিয়েছে, গোপন তথ্য, যৌথ বাহিনীর সমন্বিত পদক্ষেপ ও দ্রুত আইনি ব্যবস্থা— এই তিনটি মিলেই ফল আসে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়: আগামী প্রজন্মকে মাদকমুক্ত রাখতে পারি তো? ইসলামি নৈতিকতা, কঠোর আইন প্রয়োগ, স্বাস্থ্যসেবা এবং সচেতনতা — এই চারটি স্তম্ভ ছাড়া মাদকমুক্ত সমাজ গড়া কঠিনই বটে।

উপসংহার

গোবিন্দগঞ্জের এই ঘটনা যেমন আবারও প্রমাণ করেছে— মাদক চক্র যতই শক্তিশালী হোক, সঠিক পদক্ষেপ নিলে ধরা পড়বেই। তেমনি এটিও মনে করিয়ে দিচ্ছে— শুধু পুলিশি অভিযান নয়, পুরো সমাজকেই জেগে উঠতে হবে। ধর্মীয় মূল্যবোধ, পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আইনের কঠোর প্রয়োগ— এই সবই একসাথে না চললে মাদকমুক্ত বাংলাদেশ স্বপ্নই থেকে যাবে।

রূপান্তর সংবাদ-এ প্রতিনিধি হোন!
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে। আগ্রহীরা সিভি পাঠান: E-mail : rupantorsongbad@gmail.com

প্রতিবেদক : মাহমুদুল হাসান

সম্পাদনায় : সুমাইয়া ইসলাম/ তাবাসসুম/ মাহমুদুল