12:45 pm, Sunday, 23 November 2025

স্বার্থপরতার ছোবলে ফাটল ধরা সমাজ: উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে এখনই

  • Reporter Name
  • Update Time : 01:52:12 pm, Thursday, 26 June 2025
  • 25 Time View

মনিরুজ্জামান মনির

আজকের পৃথিবীতে “আমারটাই আগে”—এই মনোভাব ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে। ব্যক্তি স্বার্থকে সবকিছুর আগে রাখায় সমাজের নানান সংকট বাড়ছে। এটি শুধু সামাজিক বন্ধনকে দুর্বল করছে না, বরং অর্থনৈতিক বৈষম্য ও পরিবেশের ক্ষতিসাধনেও বড় ভূমিকা রাখছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই সংকট আরও বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই এখনই একযোগে ভাবতে হবে, কীভাবে এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব।

স্বার্থপরতার সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো সামাজিক সংহতির দুর্বলতা। প্রতিবেশীর দুঃখে সহানুভূতির অভাব, দুর্যোগে সাহায্যের অনীহা কিংবা সাধারণ মানবিক বন্ধুত্বের অবনতি আজকাল খুব স্বাভাবিক দৃশ্য। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘমেয়াদি গবেষণায় দেখা গেছে, পারস্পরিক সাহায্য ও সামাজিক সম্পর্কই সুখী ও দীর্ঘজীবনের মূল চাবিকাঠি। যেখানে স্বার্থপরতা বাড়ে, সেখানে মানুষ একাকিত্ব ও অবিশ্বাসের শিকার হয়।

অর্থনীতির ক্ষেত্রেও স্বার্থপরতা বৈষম্য বাড়িয়ে তোলে। অক্সফামের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী এক শতাংশ মানুষ বৈশ্বিক সম্পদের অধিকাংশই দখল করে রেখেছে, যখন কোটি কোটি মানুষ এখনও দারিদ্র্যের কাছে বাধ্য। এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যায় এবং সামষ্টিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।

পরিবেশ রক্ষায়ও স্বার্থপরতা বড় বাধা। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জাতিসংঘের লক্ষ্য অর্জনে এখনও লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে। ব্যক্তি বা রাষ্ট্র যদি স্বার্থপর হয়, তাহলে পরিবেশগত বিপর্যয় এড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত ব্যবহার, প্লাস্টিক দূষণ, অনিয়ন্ত্রিত কার্বন নিঃসরণ—এসবই এর ফলাফল।

স্বার্থপরতা মানসিক ও সামাজিক স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করে। গবেষণা দেখায়, স্বার্থপর পরিবেশে মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও অবিশ্বাস বেড়ে যায়, যা পারস্পরিক বিশ্বাসকে ভেঙে দেয়। এর প্রভাব পড়ে পরিবারের বন্ধন থেকে শুরু করে বৃহত্তর সামাজিক স্থিতিশীলতায়।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

প্রবাসী স্বজন ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক এস এম মেহেদী হাসান বলেন,
“স্বার্থপরতা সমাজে বিভাজন বাড়াচ্ছে এবং সামাজিক বন্ধন দুর্বল করছে। এর মোকাবিলায় দরকার স্পষ্ট নীতি, নৈতিক শিক্ষার প্রসার এবং জবাবদিহিতার সংস্কৃতি।”

সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক নাসরীন গীতি বলেন,
“স্বার্থপরতা কেবল ব্যক্তি নয়, প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনেও ব্যাপক। দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অসচেতনতা এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে তোলে। সামাজিক সচেতনতা ও আইনশৃঙ্খলা জোরদার করা জরুরি।”

অ্যাডভোকেট মোস্তাক আহমদ মন্তব্য করেন,
“সহযোগিতা ও ন্যায়পরায়ণতার সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারে গণমাধ্যম ও শিক্ষা ব্যবস্থার ভূমিকা অপরিসীম। মানবিকতা, সম্মান ও দায়িত্ববোধের চর্চা বাড়ানো জরুরি।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সামিউল হক বলেন,
“স্বার্থপরতা সমাজের কাঠামোগত দুর্বলতা ও অস্থিতিশীলতা বাড়ায়, যা উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। জবাবদিহিতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করাই উত্তরণের মূল পথ।”

উত্তরণের উপায়

শিক্ষায় মানবিক মূল্যবোধের অন্তর্ভুক্তি জরুরি। সহানুভূতি, নৈতিকতা, সামাজিক দায়িত্ব ও সহযোগিতা পাঠ্যক্রমের অংশ করতে হবে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, এতে সমাজ সুসংহত ও উন্নত হয়।

সামাজিক অর্থনীতির মডেল, যেমন সমবায় উদ্যোগ, সামাজিক ব্যবসা এবং পরিবেশবান্ধব নীতি গ্রহণও অপরিহার্য। বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ মডেল এ ক্ষেত্রে অনুকরণীয়।

শাসনব্যবস্থায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে, যা নিউজিল্যান্ড ও ডেনমার্কের সফলতা প্রমাণ করে। গণমাধ্যমের ভূমিকা হবে জনগণকে সচেতন করা এবং মানবিক মূল্যবোধ প্রচার করা।

ব্যক্তিগত স্তরে ছোট ছোট কাজ থেকে শুরু করতে হবে—প্রতিবেশীর খোঁজখবর নেওয়া, স্বেচ্ছাসেবী কাজ, পরিবেশ রক্ষা ও সামর্থ্য অনুযায়ী দান। গবেষণা বলছে, অন্যকে সাহায্য করলে দাতার নিজের মানসিক সুস্থতা ও সুখবোধও বাড়ে।

স্বার্থপরতা সামাজিক মহামারি, তবে মানবজাতির সাফল্য সহযোগিতা ও সহমর্মিতায় নিহিত। ‘আমার’ স্বার্থকে ‘আমাদের’ কল্যাণের সঙ্গে মিলিয়ে নিলে টেকসই ও সুস্থ সমাজ গড়া সম্ভব। এখন সময় এসেছে ‘আমরা’কে আবার আবিষ্কার করার।

সম্পাদনায় : সালেহ/ তাবাসসুম/ মেহেদী হাসান

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Popular Post

দ্রব্যমূল্য কমানো ও সর্বস্তরে রেশনিং চালুর দাবি

স্বার্থপরতার ছোবলে ফাটল ধরা সমাজ: উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে এখনই

Update Time : 01:52:12 pm, Thursday, 26 June 2025

মনিরুজ্জামান মনির

আজকের পৃথিবীতে “আমারটাই আগে”—এই মনোভাব ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে। ব্যক্তি স্বার্থকে সবকিছুর আগে রাখায় সমাজের নানান সংকট বাড়ছে। এটি শুধু সামাজিক বন্ধনকে দুর্বল করছে না, বরং অর্থনৈতিক বৈষম্য ও পরিবেশের ক্ষতিসাধনেও বড় ভূমিকা রাখছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই সংকট আরও বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই এখনই একযোগে ভাবতে হবে, কীভাবে এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব।

স্বার্থপরতার সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো সামাজিক সংহতির দুর্বলতা। প্রতিবেশীর দুঃখে সহানুভূতির অভাব, দুর্যোগে সাহায্যের অনীহা কিংবা সাধারণ মানবিক বন্ধুত্বের অবনতি আজকাল খুব স্বাভাবিক দৃশ্য। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘমেয়াদি গবেষণায় দেখা গেছে, পারস্পরিক সাহায্য ও সামাজিক সম্পর্কই সুখী ও দীর্ঘজীবনের মূল চাবিকাঠি। যেখানে স্বার্থপরতা বাড়ে, সেখানে মানুষ একাকিত্ব ও অবিশ্বাসের শিকার হয়।

অর্থনীতির ক্ষেত্রেও স্বার্থপরতা বৈষম্য বাড়িয়ে তোলে। অক্সফামের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী এক শতাংশ মানুষ বৈশ্বিক সম্পদের অধিকাংশই দখল করে রেখেছে, যখন কোটি কোটি মানুষ এখনও দারিদ্র্যের কাছে বাধ্য। এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যায় এবং সামষ্টিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।

পরিবেশ রক্ষায়ও স্বার্থপরতা বড় বাধা। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জাতিসংঘের লক্ষ্য অর্জনে এখনও লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে। ব্যক্তি বা রাষ্ট্র যদি স্বার্থপর হয়, তাহলে পরিবেশগত বিপর্যয় এড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত ব্যবহার, প্লাস্টিক দূষণ, অনিয়ন্ত্রিত কার্বন নিঃসরণ—এসবই এর ফলাফল।

স্বার্থপরতা মানসিক ও সামাজিক স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করে। গবেষণা দেখায়, স্বার্থপর পরিবেশে মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও অবিশ্বাস বেড়ে যায়, যা পারস্পরিক বিশ্বাসকে ভেঙে দেয়। এর প্রভাব পড়ে পরিবারের বন্ধন থেকে শুরু করে বৃহত্তর সামাজিক স্থিতিশীলতায়।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

প্রবাসী স্বজন ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক এস এম মেহেদী হাসান বলেন,
“স্বার্থপরতা সমাজে বিভাজন বাড়াচ্ছে এবং সামাজিক বন্ধন দুর্বল করছে। এর মোকাবিলায় দরকার স্পষ্ট নীতি, নৈতিক শিক্ষার প্রসার এবং জবাবদিহিতার সংস্কৃতি।”

সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক নাসরীন গীতি বলেন,
“স্বার্থপরতা কেবল ব্যক্তি নয়, প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনেও ব্যাপক। দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অসচেতনতা এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে তোলে। সামাজিক সচেতনতা ও আইনশৃঙ্খলা জোরদার করা জরুরি।”

অ্যাডভোকেট মোস্তাক আহমদ মন্তব্য করেন,
“সহযোগিতা ও ন্যায়পরায়ণতার সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারে গণমাধ্যম ও শিক্ষা ব্যবস্থার ভূমিকা অপরিসীম। মানবিকতা, সম্মান ও দায়িত্ববোধের চর্চা বাড়ানো জরুরি।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সামিউল হক বলেন,
“স্বার্থপরতা সমাজের কাঠামোগত দুর্বলতা ও অস্থিতিশীলতা বাড়ায়, যা উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। জবাবদিহিতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করাই উত্তরণের মূল পথ।”

উত্তরণের উপায়

শিক্ষায় মানবিক মূল্যবোধের অন্তর্ভুক্তি জরুরি। সহানুভূতি, নৈতিকতা, সামাজিক দায়িত্ব ও সহযোগিতা পাঠ্যক্রমের অংশ করতে হবে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, এতে সমাজ সুসংহত ও উন্নত হয়।

সামাজিক অর্থনীতির মডেল, যেমন সমবায় উদ্যোগ, সামাজিক ব্যবসা এবং পরিবেশবান্ধব নীতি গ্রহণও অপরিহার্য। বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ মডেল এ ক্ষেত্রে অনুকরণীয়।

শাসনব্যবস্থায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে, যা নিউজিল্যান্ড ও ডেনমার্কের সফলতা প্রমাণ করে। গণমাধ্যমের ভূমিকা হবে জনগণকে সচেতন করা এবং মানবিক মূল্যবোধ প্রচার করা।

ব্যক্তিগত স্তরে ছোট ছোট কাজ থেকে শুরু করতে হবে—প্রতিবেশীর খোঁজখবর নেওয়া, স্বেচ্ছাসেবী কাজ, পরিবেশ রক্ষা ও সামর্থ্য অনুযায়ী দান। গবেষণা বলছে, অন্যকে সাহায্য করলে দাতার নিজের মানসিক সুস্থতা ও সুখবোধও বাড়ে।

স্বার্থপরতা সামাজিক মহামারি, তবে মানবজাতির সাফল্য সহযোগিতা ও সহমর্মিতায় নিহিত। ‘আমার’ স্বার্থকে ‘আমাদের’ কল্যাণের সঙ্গে মিলিয়ে নিলে টেকসই ও সুস্থ সমাজ গড়া সম্ভব। এখন সময় এসেছে ‘আমরা’কে আবার আবিষ্কার করার।

সম্পাদনায় : সালেহ/ তাবাসসুম/ মেহেদী হাসান