2:35 pm, Sunday, 23 November 2025

বিলুপ্তির মুখে হাকালুকির রানী মাছ: হারিয়ে যাচ্ছে এক স্বাদ ও পরিবেশ ঐতিহ্য

  • Reporter Name
  • Update Time : 09:15:48 pm, Monday, 23 June 2025
  • 17 Time View

এস এম মেহেদী হাসান

বাংলাদেশের বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি হাকালুকি হাওরে একসময় খুব পরিচিত ও সুস্বাদু দেশীয় মাছ ছিল ‘রানী’। এখন এই মাছ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। স্থানীয় জেলেরা বলছেন, আগে প্রচুর পরিমাণে ধরা পড়লেও এখন সারা মৌসুমেও হাতে গোনা কয়টি ছাড়া রানী মাছ আর দেখা যায় না।

আগের মতো আর নেই

জুনের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের শুরু পর্যন্ত সময় ছিল রানী মাছ ধরার মৌসুম।
বারLekha উপজেলার অভিজ্ঞ জেলে আব্দুল মালেক বলেন:

“আগে এক-দুই ঘণ্টায় ঝুড়ি ভর্তি রানী মাছ পেতাম। এখন সারা মৌসুমেও কয়টা পেলে ভাগ্যবান মনে হয়।”

সরকারি কর্মকর্তার সতর্ক বার্তা

মৌলভীবাজার জেলার মৎস্য কর্মকর্তা ড. মোঃ আরিফ হোসেন জানান:

“বাংলাদেশে মিঠা পানির ২৬০টি প্রজাতির মাছের মধ্যে ৬৪টি ইতোমধ্যে বিলুপ্ত। হাওরে এখন পাওয়া যায় ১৪৩টি। এর মধ্যে রানী মাছ অত্যন্ত সংবেদনশীল প্রজাতি — যা পরিবেশের সামান্য পরিবর্তনেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”

তিনি বলেন, হাকালুকিতে যে ৮টি অভয়াশ্রম আছে, তাতে হয়তো রানী মাছের প্রজনন ক্ষেত্র নেই — সে জন্যই এই মাছের সংখ্যা বাড়ছে না।

কেন বিলুপ্তির পথে রানী?

  • পার্শ্ববর্তী কৃষি জমি থেকে বালাইনাশক ও সার হাওরে চলে আসা
  • অবাধ মাছ ধরা, এমনকি প্রজনন মৌসুমেও।
  • পলি জমে জলাধার ভরাট হওয়া ও বাসস্থান ধ্বংস।
  • জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, অনিয়মিত বৃষ্টি ও বন্যা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞের পর্যবেক্ষণ

ড. নুসরাত জাহান, সহযোগী অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বলেন:

“রানী মাছের মতো সংবেদনশীল প্রজাতি হাওরের সামগ্রিক পরিবেশের স্বাস্থ্য সূচক। এদের হারিয়ে যাওয়া মানে শুধু এক মাছের হার নয়, বরং সম্পূর্ণ ইকোসিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়া।”

তিনি পরামর্শ দেন, শুধু প্রজাতি নয়, সম্পূর্ণ হাওর ব্যবস্থার পুনর্বাসনবৈজ্ঞানিক প্রজনন এলাকা চিহ্নিতকরণ এখন জরুরি।

স্থানীয়দের আহ্বান

“এই মাছ আমাদের ঐতিহ্য। আমরা হারালে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধু গল্প শুনবে,” বললেন স্থানীয় জেলে জামাল উদ্দিন।

করণীয়

  • কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা অবমুক্তকরণ।
  • নতুন অভয়াশ্রম তৈরির মাধ্যমে প্রজনন ক্ষেত্র রক্ষা।
  • কৃষিকাজে ক্ষতিকর রাসায়নিকের নিয়ন্ত্রণ।
  • স্থানীয় জেলেদের নিয়ে সংরক্ষণে অংশগ্রহণমূলক কর্মসূচি।

উপসংহার

রানী মাছের হারিয়ে যাওয়া শুধু একটি প্রজাতির বিলুপ্তি নয় — বরং বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমির সংকটের প্রতিচ্ছবি। এখনই পদক্ষেপ না নিলে হারিয়ে যাবে এক অনন্য স্বাদ, সংস্কৃতি ও পরিবেশ ঐতিহ্য।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Popular Post

দ্রব্যমূল্য কমানো ও সর্বস্তরে রেশনিং চালুর দাবি

বিলুপ্তির মুখে হাকালুকির রানী মাছ: হারিয়ে যাচ্ছে এক স্বাদ ও পরিবেশ ঐতিহ্য

Update Time : 09:15:48 pm, Monday, 23 June 2025

এস এম মেহেদী হাসান

বাংলাদেশের বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি হাকালুকি হাওরে একসময় খুব পরিচিত ও সুস্বাদু দেশীয় মাছ ছিল ‘রানী’। এখন এই মাছ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। স্থানীয় জেলেরা বলছেন, আগে প্রচুর পরিমাণে ধরা পড়লেও এখন সারা মৌসুমেও হাতে গোনা কয়টি ছাড়া রানী মাছ আর দেখা যায় না।

আগের মতো আর নেই

জুনের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের শুরু পর্যন্ত সময় ছিল রানী মাছ ধরার মৌসুম।
বারLekha উপজেলার অভিজ্ঞ জেলে আব্দুল মালেক বলেন:

“আগে এক-দুই ঘণ্টায় ঝুড়ি ভর্তি রানী মাছ পেতাম। এখন সারা মৌসুমেও কয়টা পেলে ভাগ্যবান মনে হয়।”

সরকারি কর্মকর্তার সতর্ক বার্তা

মৌলভীবাজার জেলার মৎস্য কর্মকর্তা ড. মোঃ আরিফ হোসেন জানান:

“বাংলাদেশে মিঠা পানির ২৬০টি প্রজাতির মাছের মধ্যে ৬৪টি ইতোমধ্যে বিলুপ্ত। হাওরে এখন পাওয়া যায় ১৪৩টি। এর মধ্যে রানী মাছ অত্যন্ত সংবেদনশীল প্রজাতি — যা পরিবেশের সামান্য পরিবর্তনেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”

তিনি বলেন, হাকালুকিতে যে ৮টি অভয়াশ্রম আছে, তাতে হয়তো রানী মাছের প্রজনন ক্ষেত্র নেই — সে জন্যই এই মাছের সংখ্যা বাড়ছে না।

কেন বিলুপ্তির পথে রানী?

  • পার্শ্ববর্তী কৃষি জমি থেকে বালাইনাশক ও সার হাওরে চলে আসা
  • অবাধ মাছ ধরা, এমনকি প্রজনন মৌসুমেও।
  • পলি জমে জলাধার ভরাট হওয়া ও বাসস্থান ধ্বংস।
  • জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, অনিয়মিত বৃষ্টি ও বন্যা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞের পর্যবেক্ষণ

ড. নুসরাত জাহান, সহযোগী অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বলেন:

“রানী মাছের মতো সংবেদনশীল প্রজাতি হাওরের সামগ্রিক পরিবেশের স্বাস্থ্য সূচক। এদের হারিয়ে যাওয়া মানে শুধু এক মাছের হার নয়, বরং সম্পূর্ণ ইকোসিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়া।”

তিনি পরামর্শ দেন, শুধু প্রজাতি নয়, সম্পূর্ণ হাওর ব্যবস্থার পুনর্বাসনবৈজ্ঞানিক প্রজনন এলাকা চিহ্নিতকরণ এখন জরুরি।

স্থানীয়দের আহ্বান

“এই মাছ আমাদের ঐতিহ্য। আমরা হারালে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধু গল্প শুনবে,” বললেন স্থানীয় জেলে জামাল উদ্দিন।

করণীয়

  • কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা অবমুক্তকরণ।
  • নতুন অভয়াশ্রম তৈরির মাধ্যমে প্রজনন ক্ষেত্র রক্ষা।
  • কৃষিকাজে ক্ষতিকর রাসায়নিকের নিয়ন্ত্রণ।
  • স্থানীয় জেলেদের নিয়ে সংরক্ষণে অংশগ্রহণমূলক কর্মসূচি।

উপসংহার

রানী মাছের হারিয়ে যাওয়া শুধু একটি প্রজাতির বিলুপ্তি নয় — বরং বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমির সংকটের প্রতিচ্ছবি। এখনই পদক্ষেপ না নিলে হারিয়ে যাবে এক অনন্য স্বাদ, সংস্কৃতি ও পরিবেশ ঐতিহ্য।