এস এম মেহেদী হাসান, ২২ জুন ২০২৫ –
মৌলভীবাজার পাবলিক লাইব্রেরি— কেবল একটি গ্রন্থাগার নয়; জেলার শিক্ষিত, সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের প্রাণকেন্দ্র। ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই পাঠাগারই হয়ে উঠেছিল বহু পাঠকের জ্ঞানের প্রথম পাঠশালা, লেখকদের ভাবনার ঘর, গবেষকদের অনুসন্ধানের ঠিকানা।
কিন্তু সম্প্রতি ঘোষিত নতুন পরিচালনা পর্ষদকে ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে— এই প্রতিষ্ঠান তার প্রকৃত চরিত্র ও লক্ষ্য থেকে কি সরে যাচ্ছে? কারণ, দীর্ঘ ১৭ বছর পরও এখানে কোনো সরাসরি নির্বাচন হয়নি। হয়েছে কেবল ‘সিলেকশন’, যার মধ্য দিয়ে নেতৃত্বে এসেছেন এমন অনেকেই, যারা লাইব্রেরির নিয়মিত পাঠক নন।
নির্বাচন নয়, সিলেকশন— ক্ষোভের আগুন
২০০৭ সালে লাইব্রেরির সর্বশেষ সরাসরি নির্বাচন হয়েছিল। তখন পুরো মৌলভীবাজার জেলায় ছিল ভোট, প্রচার ও আলোচনার জোয়ার। পাঠক, লেখক, শিক্ষক সবাই ছিলেন সে প্রক্রিয়ার অংশ।
লাইব্রেরির প্রবীণ গ্রন্থাগারকর্মী শোভাময় রায় মনে করিয়ে দিলেন সেই সময়ের কথা। তার ভাষায়, “২০০৭ সালে প্রত্যক্ষ ভোট হয়েছিল। তখন সারা জেলায় এক আলোরণ সৃষ্টি হয়েছিল। সবাই উৎসাহের সাথে অংশ নিয়েছিলেন। এরপর আর কোনো নির্বাচন হয়নি।
মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলম শেফুল বলেন, কবে যে প্রত্যক্ষ্য ভোটে নেতা নির্বাচন করা হয়েছিল, তা আমার মতো অনেকেই ভুলে গেছে। আমরা আশা করেছিলাম, এবার নির্বাচন হবে। কিন্তু এবার যে পদ্ধতিতে কমিটি হলো, তা কেউ আশা করেনি।”
পাবলিক লাইব্রেরীর আজীবন সদস্য খিজির মোহাম্মদ জুলফিকার বলেন, আমরা চেয়েছিলাম প্রত্যক্ষ ভোটের নির্বাচন। কিন্তু তা হয়নি। এখানে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে না। তেমনি যারা লাইব্রেরীরর প্রকৃত পাঠক, তারা এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। আমরা হতাশ হয়েছি।
এই সিলেকশন প্রক্রিয়ায় সাধারণ পাঠকরা ছিলেন সম্পূর্ণ বাইরে। কোন যোগ্যতার ভিত্তিতে কারা এলেন, কারা বাদ পড়লেন— জানা যায়নি সাধারণের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাবলিক লাইব্রেরীর সাবেক এক সাধারণ সম্পাদক বলেন, এবারের কমিটি এটা বলা যায় বিএনপি-জামায়াতের কমিটি। যাদেরকে সিলেকশন করা হয়েছে, তারা কখনও দেখিনি পাঠক হিসেবে। যারা পাঠক নয়, তাদের কাছে কি আশা করা যায়!।
পাবলিক লাইব্রেরীর সাবেক নির্বাচিত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনহার আহমদ সামশাদ বলেন, ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মৌলভীবাজার পাবলিক লাইব্রেরীতে এখন পর্যন্ত মাত্র একবার নির্বাচন হয়েছে। ২০০৮ সালে ১/১১ সরকারের সময়ে নির্বাচিত কমিটির প্রচেষ্টায় ভবন নির্মাণের বাজেট বরাদ্দ ও কাজ শুরু হয়, যদিও তৎকালীন কৃষিমন্ত্রীর মাধ্যমে এই বরাদ্দ অন্যত্র নেয়ার অপচেষ্টা হয়েছিল। জেলা প্রশাসন, জেলা পরিষদ ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় সে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। অতীতে বারবার নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হয়েছে মামলা ও প্রশাসনিক জটিলতায়। বর্তমানে সুষ্ঠু নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ থাকলেও আহ্বায়ক কমিটির নিরুৎসাহ ও সদিচ্ছার অভাবে সেই আশাও অপূর্ণ। তবে বর্তমান সিলেকশন কমিটি দৃঢ় সংকল্প নিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন দিলে নতুন ইতিহাস রচনা সম্ভব—এমন প্রত্যাশাই স্থানীয়দের।”
কারা এলেন কমিটিতে?
নবনির্বাচিত কমিটির তালিকা:
- সভাপতি (পদাধিকার বলে): মোঃ ইসরাইল হোসেন (জেলা প্রশাসক)
- সহসভাপতি: শামীমা খন্দকার (জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা)
- সহসভাপতি: ইঞ্জিনিয়ার মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন
- সাধারণ সম্পাদক: শাহ আব্দুল অদুদ
- সহ-সাধারণ সম্পাদক: সৈয়দ হুমায়েদ আলী শাহীন
- সহ-সাধারণ সম্পাদক: এহসানা চৌধুরী চায়না
- কোষাধ্যক্ষ: জাহেদ আহমেদ চৌধুরী
কার্যনির্বাহী সদস্যবৃন্দ:
প্রফেসর মোঃ সেলিম, সৈয়দ রুহুল আমীন, অ্যাডভোকেট আবু তাহের, আনোয়ার হোসেন দুলাল, জাকির হোসেন উজ্জ্বল, বিশ্বজিৎ লাল দত্ত (বিজিত), মুহিদুর রহমান, মোঃ মাহবুবুর রহমান রাহেল।
স্থানীয়রা বলছেন— তালিকার অনেকে হয়তো কখনো এই পাঠাগারে নিয়মিত আসেননি। তারা নির্বাচিতও নন। আসন পেয়েছেন পরিচয়, পদবি, সামাজিক মর্যাদার কারণে। এতে প্রকৃত পাঠক-লেখকদের জায়গা হয়নি।
পাঠক-সমাজের হতাশা
বহু শিক্ষানুরাগী মনে করেন— যে পাঠাগারে নেতৃত্ব দিবে বইপড়া মানুষ, গবেষক, সাহিত্যিক— সেখানেই জ্ঞান ও সংস্কৃতির প্রবাহ থাকে। কিন্তু এখানে সেই চর্চার অভাব ঘটেছে।
এক তরুণ পাঠক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “যারা বই পড়েন না, যারা লাইব্রেরির গন্ধ চেনেন না, তারা কীভাবে পাঠাগার পরিচালনা করবেন? পাঠাগার মানে তো কাগজের স্তূপ নয়, জীবন্ত পাঠক-লেখকের মিলনক্ষেত্র।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন— গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির এই অভাবই সিলেট বিভাগে শিক্ষার হার কমে যাওয়ার বড় কারণ। লাইব্রেরি যখন মানুষের, তখন তা পাঠাভ্যাসের আশ্রয় হয়ে ওঠে। নেতারা যখন বাহিরের, তখন তা কেবল কাগুজে কাঠামো।
কেন গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্ন?
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে— দেশে ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী বছরে একটি বইও পড়ে না। মৌলভীবাজারেও বইপড়ার হার কমছে। এর পেছনে বড় কারণ— পাঠাগারগুলোর অনুৎপাদনশীলতা ও কার্যকর নেতৃত্বের অভাব।
নতুন নেতৃত্ব বারবার আশ্বাস দিচ্ছে— সংগ্রহ বাড়বে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। কিন্তু যারা নিজেরাও বই পড়েন না, তারা কীভাবে পাঠকদের বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করবেন?
লাইব্রেরি হয়ে উঠছে কেবল সরকারি কাগজপত্রের অংশ। অথচ এটি হতে পারত তরুণদের বিকাশের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। যে আলোর পথ সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো সাহিত্যিকের নামাঙ্কিত মিলনায়তন হতে পারত, সেটি এখন নিঃশব্দ।
করণীয় কী?
বিশেষজ্ঞদের মতে—
- নিয়মিত গণতান্ত্রিক নির্বাচন বাধ্যতামূলক করা।
- কমিটিতে প্রকৃত পাঠক, লেখক, গবেষকদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা।
- তরুণদের পাঠাভ্যাস বাড়াতে ওয়ার্কশপ, রিডিং সেশন চালু করা।
- সরকার ও বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে পাঠাগার সংস্কারের পদক্ষেপ।
নইলে লাইব্রেরি থেকে পাঠক হারানোর এই প্রবণতা আর রোধ করা যাবে না।
উপসংহার
মৌলভীবাজার পাবলিক লাইব্রেরি কেবল ইতিহাস নয়— বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। কিন্তু গণতন্ত্রহীনতার ছায়া তার আলোকিত পথ রুদ্ধ করছে।
প্রশ্ন উঠছে— এভাবে নির্বাচিত নয়, সিলেক্টেড কমিটি কি পারবে এই প্রতিষ্ঠানকে জেলার জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু করতে?
উত্তর সময় দেবে। তবে এ সংকেত সুস্পষ্ট— পাঠাগারে যদি বইপ্রেমিক নেতৃত্ব না আসে, তবে পাঠকও আসবে না।
সম্পাদনায়: তাবাসসুম/ সালেহ/ আসমা
Reporter Name 
























