সূরা আল-যিলযাল (সূরা ৯৯): কেয়ামতের চিত্র ও ক্ষুদ্রতম আমলের হিসাব
পবিত্র কোরআনের ৯৯তম সূরা আল-যিলযাল—একটি ছোট অথচ গভীর বার্তা সম্বলিত সূরা। এটি কেয়ামতের ভয়াবহতা, পৃথিবীর সাক্ষ্য প্রদান এবং মানুষের প্রতিটি কাজের সুস্পষ্ট হিসাবের কথা ঘোষণা করে। এই সূরার আয়াতগুলো কল্পনাতীত এক দৃশ্যপট তৈরি করে, যেখানে মানুষের গোপনতম কাজও প্রকাশিত হয়ে যাবে, এমনকি ক্ষুদ্রতম সৎ বা অসৎ কাজও।
সূরা আল-যিলযাল: আরবি পাঠ, বাংলা উচ্চারণ ও অনুবাদ
আরবি পাঠ
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
١. إِذَا زُلْزِلَتِ الْأَرْضُ زِلْزَالَهَا
٢. وَأَخْرَجَتِ الْأَرْضُ أَثْقَالَهَا
٣. وَقَالَ الْإِنسَانُ مَا لَهَا
٤. يَوْمَئِذٍ تُحَدِّثُ أَخْبَارَهَا
٥. بِأَنَّ رَبَّكَ أَوْحَىٰ لَهَا
٦. يَوْمَئِذٍ يَصْدُرُ النَّاسُ أَشْتَاتًا لِّيُرَوْا أَعْمَالَهُمْ
٧. فَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ
٨. وَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ
বাংলা উচ্চারণ
-
ইযা যুলযিলাতিল আরদু জিলযালাহা
-
ওয়া আখরাজাতিল আরদু আসকালাহা
-
ওয়া ক্বালাল ইনসানু মা লাহা
-
ইয়াওমাইযিন তুহাদ্দিসু আখবারাহা
-
বিঅন্না রাব্বাকা আওহা লাহা
-
ইয়াওমাইযিন ইয়াসদুরুন নাসু আশতাতাল লিয়ুরাউ আ’মালাহুম
-
ফামাই ইয়ামাল মিসক্বালা জররাতিন খাইরাই ইয়ারাহ
-
ওয়ামাই ইয়ামাল মিসক্বালা জররাতিন শাররাই ইয়ারাহ
বাংলা অনুবাদ
-
যখন পৃথিবী প্রবলভাবে কাঁপানো হবে,
-
আর পৃথিবী তার বোঝা (সব গোপন বিষয়) বের করে দেবে,
-
এবং মানুষ বলবে, “এর কী হয়েছে?”
-
সেদিন পৃথিবী তার সংবাদ জানাবে,
-
কারণ তোমার প্রতিপালক তাকে তা আদেশ করবেন।
-
সেদিন মানুষ বিচ্ছিন্নভাবে ফিরে আসবে, যেন তারা তাদের কাজগুলো দেখতে পায়।
-
অতঃপর যে কেউ অণু পরিমাণ ভালো কাজ করবে, সে তা দেখতে পাবে,
-
আর যে কেউ অণু পরিমাণ মন্দ কাজ করবে, সেও তা দেখতে পাবে।
সূরা নাজিল হওয়ার প্রেক্ষাপট (সানে নুযুল)
ইতিহাসবিদদের মতে, এই সূরাটি মদিনায় নাজিল হয়। সূরাটির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সমাজকে কেয়ামতের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করা। তৎকালীন অনেক মানুষ মনে করত, গোপনে করা কাজ কেউ কখনো জানতে পারবে না। এই সূরায় পরিষ্কারভাবে বলা হয়—পৃথিবী এমন এক সাক্ষী হয়ে উঠবে, যা কোনো কিছু গোপন রাখবে না।
সূরা আল-যিলযাল: তাফসির ও বিশ্লেষণ
১. কেয়ামতের ভূমিকম্প (আয়াত ১-২)
আল্লাহ ঘোষণা করেন, একদিন পৃথিবী এমনভাবে কাঁপবে যে, সে তার ভিতরে লুকিয়ে থাকা সবকিছু—মৃতদেহ, ধন-রত্ন, অপরাধ—সবকিছু বের করে দেবে। এই কম্পন হবে স্বাভাবিক নয়, বরং সর্বোচ্চ মাত্রার।
২. মানুষের বিভ্রান্তি ও বিস্ময় (আয়াত ৩)
মানুষ যখন এমন কম্পন দেখবে, তখন তারা আতঙ্কে বলে উঠবে: “এর কী হলো?” তারা বুঝবে না কী ঘটছে, এমনকি জীবন-মৃত্যু নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়বে।
৩. পৃথিবী হয়ে উঠবে সাক্ষী (আয়াত ৪-৫)
সেদিন পৃথিবী কথা বলবে। সে জানাবে কী কী ঘটেছে, কে কী করেছে। এটি এমন এক অলৌকিক ঘটনা হবে, যেখানে প্রকৃতি নিজেই সাক্ষ্য দেবে। কারণ আল্লাহ তাকে এই নির্দেশ দেবেন।
৪. আমলনামা প্রকাশ ও বিচারের ময়দান (আয়াত ৬)
মানুষ বিচ্ছিন্নভাবে একে একে আলাদা আলাদা আসবে, যেন তাদের আমল দেখানো হয়। প্রতিটি মানুষের কাজ, নিয়ত, আচরণ—সব আলাদা করে বিশ্লেষণ করা হবে।
৫. ক্ষুদ্রতম কাজও বাদ যাবে না (আয়াত ৭-৮)
এই সূরার সবচেয়ে জোরালো বার্তা হলো—একটি অণু পরিমাণ কাজও অদৃশ্য থাকবে না। মানুষ যদি সামান্যতম ভালো কাজ করে, অথবা সামান্য মন্দ কাজ করে—তাও সে দেখতে পাবে।
মূল শিক্ষা
-
আখিরাত অনিবার্য এবং তা খুবই বাস্তব।
-
প্রতিটি কাজের হিসাব হবে, এমনকি ক্ষুদ্রতম আমলও।
-
পৃথিবী ও প্রকৃতিও সাক্ষ্য দেবে মানুষের পক্ষে বা বিপক্ষে।
-
আল্লাহর জ্ঞান সর্বব্যাপী; কিছুই তাঁর কাছ থেকে গোপন নয়।
-
আমরা যা করি তা আখিরাতে আমাদের সামনে আনা হবে।
সমকালীন বার্তা
-
আজকের যুগে মানুষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধ গোপন করে, অথচ এই সূরা ঘোষণা করে—”পৃথিবী নিজেই বলবে কে কী করেছে।”
-
গোপন ক্যামেরা, গোপন লেনদেন, অন্ধকারে পাপ—সবকিছুই একদিন প্রকাশ পাবে।
-
আমাদের নৈতিকতা শুধুমাত্র সামাজিক নিয়ন্ত্রণের উপর নির্ভর করলে চলবে না, বরং আমাদের অন্তরের গভীরে আল্লাহভীতি থাকতে হবে।
উপসংহার
সূরা আল-যিলযাল আমাদের প্রতি চরমভাবে বাস্তব এক আহ্বান—জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি কর্ম—সবকিছুর হিসাব হবে। তাই এখনই সময় নিজেকে সংশোধনের, ছোট ছোট ভালো কাজকে অবহেলা না করার এবং ক্ষুদ্রতম গোনাহ থেকেও নিজেকে বাঁচিয়ে চলার। যেদিন এই পৃথিবী নিজের সাক্ষ্য দেবে, সেদিন যেন সে আমাদের পক্ষেই কথা বলে।
Reporter Name 

























