স্ত্রীর কাছে আত্মহননের ভিডিও পাঠিয়ে বিদায়: চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে এক যুবকের করুণ পরিণতি
সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম | ২৭ জুলাই ২০২৫ — চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে স্ত্রীর কাছে আত্মহননের প্রস্তুতির ভিডিও পাঠিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন এক যুবক। শনিবার (২৬ জুলাই) গভীর রাতে উপজেলার হারামিয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের একটি ভাড়া বাসায় এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ রবিবার সকালে ঝুলন্ত অবস্থায় ওই যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে।
মৃত যুবকের নাম আরাফাত (২৮)। পেশায় একজন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। তার বাবা আনোয়ার একজন দিনমজুর।
দাম্পত্য জীবনের টানাপড়েন ও হতাশার অবসান
তিন বছর আগে ঢাকায় প্রেম করে বিয়ে করেন আরাফাত। তাঁদের সংসারে রয়েছে দেড় বছর বয়সী এক কন্যাসন্তান। স্ত্রী সম্প্রতি অসুস্থ মাকে দেখতে ঢাকায় অবস্থানরত অবস্থায় সন্দ্বীপে আসেন এবং কয়েকদিন থেকে বাবার বাড়িতে ফিরে যান।
ঘটনার রাতে আরাফাত তাঁর ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া ছোট ভাই আরিফের সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিলেন। রাত দেড়টার দিকে আরিফ ঘুম ভেঙে দেখে বড় ভাই সিলিং রডে ঝুলে আছেন। চিৎকার শুনে পরিবারের সদস্যরা ছুটে এসে পুলিশে খবর দেন।
সন্দ্বীপ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এ কে এম শফিকুল ইসলাম চৌধুরী জানান,
“ঘটনাস্থল থেকে একটি চিরকুট উদ্ধার করা হয়েছে, যেখানে জীবনের প্রতি গভীর হতাশা ব্যক্ত করা হয়েছে এবং মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী না করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া, আত্মহত্যার আগে তিনি স্ত্রীর মোবাইলে একটি ভিডিও পাঠিয়েছিলেন, যেখানে আত্মহননের প্রস্তুতি দেখা যায়।”
মানসিক স্বাস্থ্য ও সমাজের নীরব সংকট
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যা কেবল একজন মানুষের মৃত্যু নয়—এটি পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।
ডা. পলাশ রায়, সহকারী অধ্যাপক, সাইকিয়াট্রি বিভাগ, এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বলেন:
“আত্মহত্যা অনেক সময় নিছক মৃত্যু নয়, এটি একটি ‘ক্রাইসিস রেসপন্স’। মৃত্যুর আগে যারা ভিডিও, নোট বা চিঠি রাখেন, তারা আসলে নিজেদের কষ্ট অন্যদের জানান দিতে চান। তাঁদের অনেকেই শেষ মুহূর্তে মন পরিবর্তনের সুযোগ পেলে বাঁচতে চাইতেন।”
তিনি আরও বলেন, “দুঃখজনক হলেও সত্য—আমাদের সমাজে মানসিক সমস্যাকে এখনো দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়। ফলে কেউ সহজে চিকিৎসার দ্বারস্থ হতে চান না। এই মনোভাব বদলাতে হবে।”
ইসলামের দৃষ্টিকোণ: আত্মহত্যা চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ
ইসলামে আত্মহত্যা কঠোরভাবে হারাম এবং মহাপাপ। কুরআন ও সহিহ হাদীসে রয়েছে এর বিরুদ্ধে স্পষ্ট সতর্কতা।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
“আর তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু।”
(সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৯)
এই আয়াত প্রসঙ্গে তাফসিরকারকগণ বলেন, এটি আত্মহত্যার সরাসরি নিষেধাজ্ঞা। জীবনের প্রতি অবহেলা, হতাশা বা ক্রোধের বশবর্তী হয়ে নিজেকে হত্যা করা ইসলামসম্মত নয়।
মাওলানা শেখ সাদ আহমদ আমিন বর্ণভী, মোহতামিম, মিশকাতুল কোরআন মাদরাসা বলেন:
“আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। এটি আল্লাহর নির্ধারিত জীবনের সীমা অমান্য করা। ইসলামে জীবন হলো আমানত। যারা কষ্টে আছে, তাদের ধৈর্য ধরতে বলা হয়েছে। কারণ, কষ্টের পরেই আসে সহায়তা। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি।’ (সূরা ইনশিরাহ, আয়াত ৬-৭)”
সামাজিক বাস্তবতা ও করণীয়
বাংলাদেশে আত্মহত্যা এখন একটি নীরব মহামারিতে পরিণত হয়েছে। পারিবারিক কলহ, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, সম্পর্কের জটিলতা এবং মানসিক রোগ শনাক্তের অভাব—সব মিলিয়ে মানুষ হতাশার গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, করণীয় হচ্ছে:
-
স্কুল ও কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা
-
পরামর্শ কেন্দ্র ও হেল্পলাইন জোরদার করা
-
পারিবারিক যোগাযোগ ও সহানুভূতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি
-
ধর্মীয় অনুশাসনের বাস্তব চর্চা
উপসংহার
আরাফাতের আত্মহনন কেবল একটি পরিবারের শোক নয়, এটি সমাজের সামনে একটি বড় প্রশ্ন রেখে গেল—আমরা কতটা মনোযোগী আমাদের চারপাশে থাকা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষদের প্রতি?
এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের নীরবতা ভাঙার মধ্যেই নিহিত।
— আহমদুল হাসান/ তাবাসসুম/ এস এম মেহেদী
আহমদুল হাসান 



























