1:36 pm, Sunday, 23 November 2025

নৌকার হাটে বর্ষার ছোঁয়ায় জমজমাট বিক্রি: জীবনধারণে ভরসা কাঠের নৌকা

নৌকার হাটে বর্ষার ছোঁয়ায় জমজমাট বিক্রি: জীবনধারণে ভরসা কাঠের নৌকা

আগৈলঝাড়া, বরিশাল | ২৩ জুলাই ২০২৫  —   বর্ষা মৌসুম শুরু হতেই বরিশালের আগৈলঝাড়ায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে ঐতিহ্যবাহী নৌকা শিল্প। উপজেলার সাহেবেরহাট ও বাহাদুরপুরে জমে উঠেছে নৌকা বিক্রির হাট, যেখানে প্রতি সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ নৌকা। পণ্য পরিবহন, যাতায়াত ও মৎস্য আহরণে ব্যবহার উপযোগী এসব নৌকা তৈরি ও বিক্রির মাধ্যমে সহস্রাধিক পরিবার তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে।

প্রাচীন এই হাটগুলো এখনো গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। সপ্তাহে দু’দিন—সোমবার ও বৃহস্পতিবার বসে এই হাট। বন্যা ও বর্ষার আগাম প্রস্তুতি হিসেবে নিম্নাঞ্চলের সাধারণ মানুষ নৌকা সংগ্রহে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। বিশেষ করে মৎস্যজীবী ও কৃষিজীবী পরিবারগুলো নৌকার ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে এ সময়টায়।

কাঠমিস্ত্রীরা বর্ষাকালে বাড়িতে বসেই তৈরি করছেন বিভিন্ন সাইজ ও ডিজাইনের ডিঙ্গি ও মাঝারি আকৃতির নৌকা। স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত গাছের কাঠ যেমন জারুল, রেইনট্রি, চাম্বল, কদম, মেহগনি, আমগাছ ইত্যাদি দিয়ে তৈরি হচ্ছে নৌকাগুলো। সেগুলো স-মিলে চেরাই করে তৈরি করা হয় সম্পূর্ণ হাতে। নৌকার আকার ও কাঠের মান অনুযায়ী দাম নির্ধারিত হয়—৩ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। একটি সাধারণ ডিঙ্গি নৌকার গড় মূল্য ৭-৮ হাজার টাকা।

স্থানীয়দের অভিমত:
সাহেবেরহাট হাটে কথা হয় গৌরনদী উপজেলার বাসুদেবপাড়া গ্রামের মো. শাহজাহান হাওলাদারের সঙ্গে। তিনি জানান, “পানের বরজ আর গরুর খাবার আনতে দুইটি নৌকা কিনেছি ৮ হাজার ৪শ’ টাকায়।”
উজিরপুর উপজেলার কালবিলা গ্রামের নির্মল হালদার বলেন, “বিভিন্ন এলাকা থেকে ২৪টি নৌকা কিনে এনেছি বিক্রির জন্য। ইতিমধ্যে ৮টি বিক্রি হয়েছে। কাঠের দাম বাড়ায় এবার দাম কিছুটা বেশি।”

নির্মাতা পরিবারগুলোর বাস্তবতা:
এই শিল্পে শুধু পুরুষরাই নয়, যুক্ত হচ্ছেন পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও। নারীরা রং করার কাজ, নৌকার রশি বাঁধা, শুকানো ও অন্যান্য সহযোগিতামূলক কাজে অংশ নিচ্ছেন। এতে বাড়ছে পরিবারের অতিরিক্ত আয়, আবার টিকে থাকছে এক প্রাচীন কৃষ্টিও।

হাট কমিটির ভাষ্য:
সাহেবেরহাট কমিটির সভাপতি মতিউর রহমান শিকদার বলেন, “শতবর্ষের এই হাটে এখনো পুরোদমে চলছে নৌকা কেনাবেচা। আগৈলঝাড়া ছাড়াও কোটালীপাড়া, বানারীপাড়া, মাদারীপুর, যশোরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা এখানে নৌকা কিনতে আসেন।”

বিশ্লেষণ:
বাংলাদেশের বহু অঞ্চলের মতো আগৈলঝাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বন্যা ও বর্ষার প্রকোপে প্রভাবিত। এই বাস্তবতায় নৌকা হয়ে উঠেছে শুধু একটি পরিবহন মাধ্যম নয়, বরং টিকে থাকার হাতিয়ার। নৌকা কেন্দ্রিক এই হাটগুলো গ্রামীণ অর্থনীতির প্রাণ। সরকার ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সহযোগিতা পেলে এই ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প হতে পারে একটি টেকসই আয়ের খাত।

— সালেহ/ তাবাসসুম/ মেহেদী হাসান

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Popular Post

দ্রব্যমূল্য কমানো ও সর্বস্তরে রেশনিং চালুর দাবি

নৌকার হাটে বর্ষার ছোঁয়ায় জমজমাট বিক্রি: জীবনধারণে ভরসা কাঠের নৌকা

Update Time : 07:30:22 pm, Wednesday, 23 July 2025

নৌকার হাটে বর্ষার ছোঁয়ায় জমজমাট বিক্রি: জীবনধারণে ভরসা কাঠের নৌকা

আগৈলঝাড়া, বরিশাল | ২৩ জুলাই ২০২৫  —   বর্ষা মৌসুম শুরু হতেই বরিশালের আগৈলঝাড়ায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে ঐতিহ্যবাহী নৌকা শিল্প। উপজেলার সাহেবেরহাট ও বাহাদুরপুরে জমে উঠেছে নৌকা বিক্রির হাট, যেখানে প্রতি সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ নৌকা। পণ্য পরিবহন, যাতায়াত ও মৎস্য আহরণে ব্যবহার উপযোগী এসব নৌকা তৈরি ও বিক্রির মাধ্যমে সহস্রাধিক পরিবার তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে।

প্রাচীন এই হাটগুলো এখনো গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। সপ্তাহে দু’দিন—সোমবার ও বৃহস্পতিবার বসে এই হাট। বন্যা ও বর্ষার আগাম প্রস্তুতি হিসেবে নিম্নাঞ্চলের সাধারণ মানুষ নৌকা সংগ্রহে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। বিশেষ করে মৎস্যজীবী ও কৃষিজীবী পরিবারগুলো নৌকার ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে এ সময়টায়।

কাঠমিস্ত্রীরা বর্ষাকালে বাড়িতে বসেই তৈরি করছেন বিভিন্ন সাইজ ও ডিজাইনের ডিঙ্গি ও মাঝারি আকৃতির নৌকা। স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত গাছের কাঠ যেমন জারুল, রেইনট্রি, চাম্বল, কদম, মেহগনি, আমগাছ ইত্যাদি দিয়ে তৈরি হচ্ছে নৌকাগুলো। সেগুলো স-মিলে চেরাই করে তৈরি করা হয় সম্পূর্ণ হাতে। নৌকার আকার ও কাঠের মান অনুযায়ী দাম নির্ধারিত হয়—৩ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। একটি সাধারণ ডিঙ্গি নৌকার গড় মূল্য ৭-৮ হাজার টাকা।

স্থানীয়দের অভিমত:
সাহেবেরহাট হাটে কথা হয় গৌরনদী উপজেলার বাসুদেবপাড়া গ্রামের মো. শাহজাহান হাওলাদারের সঙ্গে। তিনি জানান, “পানের বরজ আর গরুর খাবার আনতে দুইটি নৌকা কিনেছি ৮ হাজার ৪শ’ টাকায়।”
উজিরপুর উপজেলার কালবিলা গ্রামের নির্মল হালদার বলেন, “বিভিন্ন এলাকা থেকে ২৪টি নৌকা কিনে এনেছি বিক্রির জন্য। ইতিমধ্যে ৮টি বিক্রি হয়েছে। কাঠের দাম বাড়ায় এবার দাম কিছুটা বেশি।”

নির্মাতা পরিবারগুলোর বাস্তবতা:
এই শিল্পে শুধু পুরুষরাই নয়, যুক্ত হচ্ছেন পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও। নারীরা রং করার কাজ, নৌকার রশি বাঁধা, শুকানো ও অন্যান্য সহযোগিতামূলক কাজে অংশ নিচ্ছেন। এতে বাড়ছে পরিবারের অতিরিক্ত আয়, আবার টিকে থাকছে এক প্রাচীন কৃষ্টিও।

হাট কমিটির ভাষ্য:
সাহেবেরহাট কমিটির সভাপতি মতিউর রহমান শিকদার বলেন, “শতবর্ষের এই হাটে এখনো পুরোদমে চলছে নৌকা কেনাবেচা। আগৈলঝাড়া ছাড়াও কোটালীপাড়া, বানারীপাড়া, মাদারীপুর, যশোরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা এখানে নৌকা কিনতে আসেন।”

বিশ্লেষণ:
বাংলাদেশের বহু অঞ্চলের মতো আগৈলঝাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বন্যা ও বর্ষার প্রকোপে প্রভাবিত। এই বাস্তবতায় নৌকা হয়ে উঠেছে শুধু একটি পরিবহন মাধ্যম নয়, বরং টিকে থাকার হাতিয়ার। নৌকা কেন্দ্রিক এই হাটগুলো গ্রামীণ অর্থনীতির প্রাণ। সরকার ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সহযোগিতা পেলে এই ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প হতে পারে একটি টেকসই আয়ের খাত।

— সালেহ/ তাবাসসুম/ মেহেদী হাসান