2:52 pm, Sunday, 23 November 2025

টাঙ্গুয়ার হাওর: দায়িত্বহীন পর্যটনের হুমকিতে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ

  • Reporter Name
  • Update Time : 04:36:17 am, Monday, 14 July 2025
  • 23 Time View

লিখেছেন: এস এম মেহেদী হাসান

সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমির একটি এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রামসার সাইট। হাজারো পরিযায়ী পাখি ও নানা ধরনের জলজ প্রাণীর আবাসস্থল এই হাওর স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্যও এক অমূল্য পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক সম্পদ। কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন ও দায়িত্বহীন পর্যটন এই প্রাকৃতিক সম্পদের অস্তিত্বকেই আজ হুমকির মুখে ফেলছে।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন বহুদিন ধরে টাঙ্গুয়ার হাওরে ক্ষতিকর পর্যটন কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ ও নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করে আসছে। অনেক অংশীজন এসব প্রচেষ্টার পক্ষে থাকলেও, পর্যাপ্ত লজিস্টিক ও আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে কার্যকর বাস্তবায়ন এখনও চ্যালেঞ্জিং।

টাঙ্গুয়ার হাওরের অক্ষত সৌন্দর্য রক্ষায় সম্মিলিত দায়িত্ব প্রয়োজন। শুধু জেলা প্রশাসনের নয়, সচেতন নাগরিক, পর্যটক ও ব্যবসায়ীদেরও এই ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় এগিয়ে আসা দরকার। একমাত্র সমন্বিত ও ধারাবাহিক উদ্যোগই এ ক্ষয় রোধ করতে পারে।

টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপের দাবি

২০২৫ সালের ১৮ই জুন হাওর অঞ্চলের বাসিন্দারা ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। তারা অবিলম্বে টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপের দাবি জানান। কর্মসূচিতে দায়িত্বহীন পর্যটন নিয়ন্ত্রণ ও হাওরের সংবেদনশীল বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় ছয়টি মূল দাবি উপস্থাপন করা হয়।

বক্তারা টাঙ্গুয়ার হাওরের রামসার সাইট হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান এবং হাজারো পরিযায়ী পাখি ও জলজ জীববৈচিত্র্যের কথা তুলে ধরেন। তারা অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের কারণে বিপজ্জনক পরিবেশগত বিপর্যয়ের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। এর মধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্যের দূষণ, শব্দ ও আলোর দূষণ এবং হাউসবোটের নিয়ন্ত্রণহীন চলাচল অন্যতম। ২০১৮ সালের এক পাখি জরিপে দেখা যায়, এ হাওরে প্রায় ৬০,০০০ জলপাখির বাস ছিল, যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৩,০০০-এ।

মানববন্ধনের ছয়টি দাবি:

  • হাউসবোটের সংখ্যা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার নির্দেশিকা কার্যকর করা।
  • পর্যটন ব্যবসায়ীদের দ্বারা প্লাস্টিকসহ সব বর্জ্য সঠিকভাবে সংগ্রহ, নিষ্পত্তি ও পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করা।
  • টাঙ্গুয়ার হাওর ব্যবস্থাপনায় সরকারিভাবে সুস্পষ্ট ও পরিবেশবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রচার।
  • জেলা প্রশাসন ও পর্যটন ব্যবসায়ীদের যৌথ উদ্যোগে কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।
  • পাখি, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর ক্ষতি কমাতে শব্দ, আলো ও নৌযান চলাচল নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ।
  • জেলা প্রশাসনের নিয়মিত পরিবেশ পর্যবেক্ষণ ও আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা।

মানববন্ধনের সভাপতিত্ব করেন হাওরবাসীর প্রধান সমন্বয়ক ড. হালিম দাদ খান। বক্তৃতা দেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব ড. সৈয়দ উমর খায়াম, ড. গোলাম শফিক, হাওর উন্নয়ন পরিষদের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট ফরিদ উদ্দিন এবং বিভিন্ন পরিবেশবাদী ও সাংবাদিকরা।

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রহীন পর্যটনের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে

২০২৫ সালের ৩০শে মে প্রাথমিক আলো সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়, টাঙ্গুয়ার হাওরের উত্তর তীরের শহীদ সিরাজ হ্রদ (নীলাদ্রি লেক) এলাকায় ‘রাহবার’ নামের একটি হাউসবোটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। রাত ৮টার দিকে আগুন লাগে এবং নিকটবর্তী নৌকা গিয়ে ১২ জন পর্যটককে উদ্ধার করলেও নৌযানটি সম্পূর্ণভাবে পুড়ে যায়। তাহিরপুর থানার প্রাথমিক তদন্তে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাতের কথা বলা হয়েছে।

এই দুর্ঘটনা স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয়, বিশেষত ছুটির দিনে রাতভর হাউসবোটে থাকা পর্যটকের সংখ্যা বাড়ার কারণে নিরাপত্তাহীনতা ও পরিবেশগত ক্ষতির ঝুঁকি কতটা বাড়ছে। স্থানীয় নৌযান মালিক ও প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরেই এই অব্যবস্থাপনায় শঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন।

উপসংহার: টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে

টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষায় শুধু সরকারের কঠোর উদ্যোগ নয়, পর্যটক, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সচেতন নাগরিকদের দায়িত্বশীল আচরণ ও সচেতনতা বৃদ্ধিও জরুরি। একমাত্র সম্মিলিত ও ধারাবাহিক উদ্যোগের মাধ্যমেই এই প্রাকৃতিক রত্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভব।

লেখক পরিচিতি:
এস এম মেহেদী হাসান বাংলাদেশের একজন সাংবাদিক, যিনি পরিবেশ, টেকসই পর্যটন ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে কাজ করেন। এটি তার প্রথম আন্তর্জাতিক লেখা।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Popular Post

দ্রব্যমূল্য কমানো ও সর্বস্তরে রেশনিং চালুর দাবি

টাঙ্গুয়ার হাওর: দায়িত্বহীন পর্যটনের হুমকিতে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ

Update Time : 04:36:17 am, Monday, 14 July 2025

লিখেছেন: এস এম মেহেদী হাসান

সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমির একটি এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রামসার সাইট। হাজারো পরিযায়ী পাখি ও নানা ধরনের জলজ প্রাণীর আবাসস্থল এই হাওর স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্যও এক অমূল্য পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক সম্পদ। কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন ও দায়িত্বহীন পর্যটন এই প্রাকৃতিক সম্পদের অস্তিত্বকেই আজ হুমকির মুখে ফেলছে।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন বহুদিন ধরে টাঙ্গুয়ার হাওরে ক্ষতিকর পর্যটন কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ ও নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করে আসছে। অনেক অংশীজন এসব প্রচেষ্টার পক্ষে থাকলেও, পর্যাপ্ত লজিস্টিক ও আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে কার্যকর বাস্তবায়ন এখনও চ্যালেঞ্জিং।

টাঙ্গুয়ার হাওরের অক্ষত সৌন্দর্য রক্ষায় সম্মিলিত দায়িত্ব প্রয়োজন। শুধু জেলা প্রশাসনের নয়, সচেতন নাগরিক, পর্যটক ও ব্যবসায়ীদেরও এই ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় এগিয়ে আসা দরকার। একমাত্র সমন্বিত ও ধারাবাহিক উদ্যোগই এ ক্ষয় রোধ করতে পারে।

টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপের দাবি

২০২৫ সালের ১৮ই জুন হাওর অঞ্চলের বাসিন্দারা ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। তারা অবিলম্বে টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপের দাবি জানান। কর্মসূচিতে দায়িত্বহীন পর্যটন নিয়ন্ত্রণ ও হাওরের সংবেদনশীল বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় ছয়টি মূল দাবি উপস্থাপন করা হয়।

বক্তারা টাঙ্গুয়ার হাওরের রামসার সাইট হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান এবং হাজারো পরিযায়ী পাখি ও জলজ জীববৈচিত্র্যের কথা তুলে ধরেন। তারা অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের কারণে বিপজ্জনক পরিবেশগত বিপর্যয়ের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। এর মধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্যের দূষণ, শব্দ ও আলোর দূষণ এবং হাউসবোটের নিয়ন্ত্রণহীন চলাচল অন্যতম। ২০১৮ সালের এক পাখি জরিপে দেখা যায়, এ হাওরে প্রায় ৬০,০০০ জলপাখির বাস ছিল, যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৩,০০০-এ।

মানববন্ধনের ছয়টি দাবি:

  • হাউসবোটের সংখ্যা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার নির্দেশিকা কার্যকর করা।
  • পর্যটন ব্যবসায়ীদের দ্বারা প্লাস্টিকসহ সব বর্জ্য সঠিকভাবে সংগ্রহ, নিষ্পত্তি ও পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করা।
  • টাঙ্গুয়ার হাওর ব্যবস্থাপনায় সরকারিভাবে সুস্পষ্ট ও পরিবেশবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রচার।
  • জেলা প্রশাসন ও পর্যটন ব্যবসায়ীদের যৌথ উদ্যোগে কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।
  • পাখি, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর ক্ষতি কমাতে শব্দ, আলো ও নৌযান চলাচল নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ।
  • জেলা প্রশাসনের নিয়মিত পরিবেশ পর্যবেক্ষণ ও আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা।

মানববন্ধনের সভাপতিত্ব করেন হাওরবাসীর প্রধান সমন্বয়ক ড. হালিম দাদ খান। বক্তৃতা দেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব ড. সৈয়দ উমর খায়াম, ড. গোলাম শফিক, হাওর উন্নয়ন পরিষদের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট ফরিদ উদ্দিন এবং বিভিন্ন পরিবেশবাদী ও সাংবাদিকরা।

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রহীন পর্যটনের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে

২০২৫ সালের ৩০শে মে প্রাথমিক আলো সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়, টাঙ্গুয়ার হাওরের উত্তর তীরের শহীদ সিরাজ হ্রদ (নীলাদ্রি লেক) এলাকায় ‘রাহবার’ নামের একটি হাউসবোটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। রাত ৮টার দিকে আগুন লাগে এবং নিকটবর্তী নৌকা গিয়ে ১২ জন পর্যটককে উদ্ধার করলেও নৌযানটি সম্পূর্ণভাবে পুড়ে যায়। তাহিরপুর থানার প্রাথমিক তদন্তে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাতের কথা বলা হয়েছে।

এই দুর্ঘটনা স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয়, বিশেষত ছুটির দিনে রাতভর হাউসবোটে থাকা পর্যটকের সংখ্যা বাড়ার কারণে নিরাপত্তাহীনতা ও পরিবেশগত ক্ষতির ঝুঁকি কতটা বাড়ছে। স্থানীয় নৌযান মালিক ও প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরেই এই অব্যবস্থাপনায় শঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন।

উপসংহার: টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে

টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষায় শুধু সরকারের কঠোর উদ্যোগ নয়, পর্যটক, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সচেতন নাগরিকদের দায়িত্বশীল আচরণ ও সচেতনতা বৃদ্ধিও জরুরি। একমাত্র সম্মিলিত ও ধারাবাহিক উদ্যোগের মাধ্যমেই এই প্রাকৃতিক রত্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভব।

লেখক পরিচিতি:
এস এম মেহেদী হাসান বাংলাদেশের একজন সাংবাদিক, যিনি পরিবেশ, টেকসই পর্যটন ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে কাজ করেন। এটি তার প্রথম আন্তর্জাতিক লেখা।