রাজশাহী| ১২ জুলাই ২০২৫ —
রাজশাহীর পুঠিয়া, চারঘাট, বাঘা ও আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা দেশের অন্যতম পেঁয়াজ উৎপাদন অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। বছরের পর বছর ধরে এই অঞ্চলের হাজার হাজার কৃষক জীবিকা নির্বাহ করছেন পেঁয়াজ চাষ করে। অথচ এবার মৌসুমের শেষ প্রান্তেও বাজারে ন্যায্য দাম না পেয়ে মাথায় হাত পড়েছে চাষিদের।
এক বিঘা জমিতে এক লাখ, দাম উঠছে না
পুঠিয়ার কৃষক আব্দুল মজিদ দীর্ঘ ২০ বছর ধরে পেঁয়াজ চাষ করছেন। তার মতে, এক বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করতে খরচ হচ্ছে ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত। জমি প্রস্তুত, বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ, শ্রমিক মজুরি—সব মিলিয়ে খরচের অঙ্ক দিন দিন বাড়ছে। অথচ বাজারে এক কেজি কাঁচা পেঁয়াজ বিক্রি করতে হচ্ছে ২৫–৩০ টাকায়, যেখানে উৎপাদন ব্যয়ই প্রায় ২৮–৩০ টাকা।
‘‘প্রতি কেজিতে গড়ে ৫–১০ টাকা ক্ষতি হচ্ছে। এর সাথে আছে শুকনো পেঁয়াজের ওজন কমা আর আড়ৎদারের বাড়তি ওজনে নেওয়া। হিসাব করলে লোকসানের অঙ্ক আরও বড় হয়,’’ ক্ষোভের সুরে বলছিলেন আব্দুল মজিদ।
শুকনো পেঁয়াজে দ্বিগুণ ক্ষতি
পেঁয়াজ তোলার পর প্রায় ৪০ কেজি কাঁচা পেঁয়াজ শুকিয়ে বা পচে ২৫–২৮ কেজিতে নেমে আসে। দেশের প্রচলিত বাজার প্রথায় ৪২ কেজিকে ১ মণ ধরা হয়। ফলে প্রতিমণে ওজনে বাড়তি ক্ষতি কৃষকের কাঁধে চাপে।
চাষি আব্দুল মমিনের কথায়, ‘‘২ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ করেছি। ফলন ভালো হয়নি, দামও পেলাম না। মৌসুমের শেষে ভালো দাম পাবো ভেবেছিলাম, তাও হলো না। বাজারে মণপ্রতি দাম থাকছে ১৬০০–১৮০০ টাকা, যেখানে ২২০০–২৫০০ টাকা হলে অন্তত খরচ উঠতো।’’
দায়ী কে?
কৃষকরা সরাসরি দায়ী করছেন একদিকে খোলা বাজারে বিপুল পেঁয়াজ আমদানিকে, অন্যদিকে স্থানীয় বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক উম্মে সালমা স্বীকার করেছেন, ‘‘উৎপাদন বেশি হওয়ায় দামে প্রভাব পড়ছে। পেঁয়াজ পচনশীল, তাই সংরক্ষণের ব্যবস্থা জরুরি। আমরা ইতিমধ্যেই কিছু এলাকায় ইয়ার ফ্লো পদ্ধতির ঘর তৈরি করেছি। এই পদ্ধতিতে পেঁয়াজের ওজন কমা ও পচন অনেকাংশে রোধ করা যায়।’’
বাজার আর আড়ৎদার: দুই ধারেই চাপ
বানেশ্বর বাজারের আড়ৎদার মনসুর রহমান বললেন, ‘‘পেঁয়াজের দাম ঢাকায় কম। আমরা কৃষকের ছেলে, আমরাও চাই ভালো দাম দিতে। কিন্তু ঢাকায় মোকামে কম দামে বিক্রি করতে হয়। আমরা যখন পেঁয়াজ কিনে বস্তা প্যাকেট করি, তখন কিছু পচে যায়, ওজনে কমে যায়। তাই ২ কেজি বেশি নিতে হয়। না হলে আমাদেরও লোকসান হয়।’’
ভোক্তার হিসাব: দাম সস্তা, তবু কৃষকের হাহাকার
পেঁয়াজের দাম কম থাকায় স্বস্তি পেয়েছেন সাধারণ ক্রেতারা। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মুস্তাক আহম্মদ বললেন, ‘‘আমরা ৫০–৬০ টাকার বেশি কেজি পেঁয়াজ কিনলে আমাদেরই সমস্যা। তবে কৃষকের ক্ষতি হলেও আমাদের বাজার সুবিধা পাচ্ছে, এটাও সত্যি।’’
ভবিষ্যৎ সংকট: চাষে অনাগ্রহ
কৃষিবিদ কাজী লুৎফুল বারী (অবসরপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক) বলেন, ‘‘মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমিয়ে কৃষক ও ভোক্তার স্বার্থ সুরক্ষায় তাদেরকে আরও ক্ষমতায়িত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ ও কার্যকর উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি। সরকার যদি উৎপাদক পর্যায় থেকে পণ্য সরাসরি ঢাকাসহ প্রধান ভোক্তা বাজারে সরকারি ব্যবস্থাপনায় সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তাহলে কৃষক ন্যায্য মূল্য পাবেন এবং ভোক্তারাও ন্যায্য দামে পণ্য ক্রয়ের সুযোগ পাবেন। এতে কৃষক ও ভোক্তা—দুই পক্ষই প্রকৃত অর্থে উপকৃত হবেন।’’
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি। লোকসানের ভয়ে অনেকে পেঁয়াজ চাষ ছেড়ে অন্য ফসল বা বর্গা চাষের দিকে ঝুঁকছেন। এতে উৎপাদন ঘাটতি তৈরি হলে তখন দাম বাড়িয়ে বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে, যা বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের চাপ বাড়াবে।
কৃষিবিদ ড. শামছুল আলম বলেন, ‘‘পেঁয়াজ চাষ টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারকে মাঠ পর্যায়ে বাজার পর্যবেক্ষণ, সংরক্ষণ প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেওয়া, মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ ও প্রয়োজনে শুল্ক আরোপের মতো দ্রুত হস্তক্ষেপ করতে হবে। না হলে একদিন দেশের পেঁয়াজের স্বয়ংসম্পূর্ণতা হারিয়ে যাবে।’’
রূপান্তর সংবাদ-এ প্রতিনিধি হোন!
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে। আগ্রহীরা সিভি পাঠান: E-mail : rupantorsongbad@gmail.com
প্রতিবেদক : মোহাম্মদ আলী
সম্পাদনায় : সুমাইয়া/ তাবাসসুম/ মেহেদী
Reporter Name 


























