ঢাকা। ৯ জুলাই ২০২৫-
ইসলামী বিবাহ: চুক্তি ও ন্যায়বিচার
ইসলাম ধর্মে বিবাহ শুধু সামাজিক চুক্তি নয় — এটি একটি বৈধ, পূর্ণাঙ্গ চুক্তি। এই চুক্তিতে নারী-পুরুষের অধিকার ও দায়িত্ব স্পষ্টভাবে নির্ধারিত। এর অন্যতম মূল ভিত্তি মোহরানা বা দেনমোহর।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,
“তোমরা নারীদের মোহর আনন্দের সাথে পরিপূর্ণভাবে প্রদান করো…” (সূরা নিসা, ৪:৪)
রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন,
“তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম হলো সেই ব্যক্তি, যে তার পরিবারের কাছে উত্তম আচরণ করে।” (তিরমিজি)
অর্থাৎ, মোহরানা কোনো করুণা নয় — এটি স্ত্রীর প্রাপ্য অধিকার। ইসলামে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের আগে মোহরানা প্রদান করা বাধ্যতামূলক। সহীহ হাদিসে এ বিষয়ে কোনো শৈথিল্য নেই।
বাস্তব চিত্র: বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু মুসলিম সমাজে বাস্তবে মোহরানা নিয়ে গভীর সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। মোহরানার প্রকৃত উদ্দেশ্য নষ্ট হয়ে গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন:
“মোহরানা মূলত নারীর অধিকার রক্ষার নিরাপত্তা। কিন্তু এখন তা অঘোষিত যৌতুকের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজে প্রতিযোগিতা চলে — কে কত বেশি মোহরানা লিখতে পারবে!”
বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় গড় মোহরানা ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা। শহরাঞ্চলে তা ৫ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকাও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বরের প্রকৃত আর্থিক সক্ষমতা প্রায়ই এতোটা থাকে না।
মোহরানা নিয়ে বিচ্ছেদ ও মামলা
বাংলাদেশের পারিবারিক আদালতগুলোতে বছরে প্রায় ১২–১৫ হাজার বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত মামলা হয়। এর প্রায় ৪০% মামলা মোহরানা পরিশোধ না করার জটিলতায় সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান ও ভারতের মুসলিম সমাজেও একই সমস্যা প্রকট। পাকিস্তানের লাহোর হাই কোর্টের ২০২১ সালের সমীক্ষা বলছে, বিবাহ বিচ্ছেদ জনিত মামলার ৬০% এর মূল কেন্দ্রবিন্দু মোহরানা নিয়ে বিরোধ।
ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বর বলেন, “আমার স্ত্রী নামাজ পড়ে না। রোজা রাখে না। শারীরিক মিলনের পর গোসল করে না। আমার মা-বাবাকে গালাগালি করে। আমি তাকে তালাক দিতে চাই — কিন্তু মোহরানা তিন লাখ টাকা। আমি দিতে পারছি না। তালাক দিলেই পুরোটা পরিশোধ করতে হবে। এখন আমার পক্ষে কোনো পথ খোলা নেই।”
একইভাবে স. অধ্যক্ষ নামের আরেকজন জানান, “আমার স্ত্রীর সাথে সংসার করা দুঃসহ। প্রতিনিয়ত গালিগালাজ, হুমকি। কাবিন ১৫ লাখ টাকা। দিতে পারছি না বলে বিচ্ছেদও করতে পারছি না।”
চট্টগ্রামের আলোচিত ঘটনা
২০২২ সালের চট্টগ্রামে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছিল। চট্টগ্রামের এক চিকিৎসক (নাম গোপন রাখা হলো) মাত্র দুই বছরের দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর মানসিক নির্যাতন ও ৩৫ লাখ টাকার কাবিনের চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। প্রতিবেশী ও স্বজনদের ভাষ্যমতে, স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে গিয়ে চিকিৎসক বুঝতে পারেন — পুরো মোহরানা একসাথে পরিশোধ করতে না পারলে মুক্তি নেই।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির রেকর্ডে এই আত্মহত্যার কারণ ‘পারিবারিক নির্যাতন ও দেনমোহর পরিশোধের চাপ’ হিসেবে উল্লেখ রয়েছে।
কাজী ও আইনজীবীর পর্যবেক্ষণ
কাজী হারুন উর রশীদ বলেন,
“অনেক বরের আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনা না করে মোহরানা নির্ধারণ হয়। পরে স্ত্রী যদি অযৌক্তিক আচরণও করে, তবু সেই মোহরানা তাকে দিতে হয়। এর সমাধান হলো ইসলামি শরীয়াহ মেনে সাধ্য অনুযায়ী মোহর নির্ধারণ এবং তা শারীরিক মিলনের আগেই পরিশোধ করা।”
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট জাকির হোসেন ভূইয়া বলেন, “বাংলাদেশের পারিবারিক আদালতে মোহরানা নিয়ে মামলা দীর্ঘায়িত হয়। বছরের পর বছর মামলা চলতে থাকে। অনেক পুরুষ আর্থিক ও সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ইসলামী নীতিমালা মেনে চললে এমন হয় না।”
মুক্তিবাণী নিউজের সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির এ বিষয়ে বলেন, “গ্রেটার সিলেটে একটি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে দেনমোহর প্রথা। বিশেষ করে আমাদের যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা বা পশ্চিমাদেশ গুলোতে বসবাসকারী সিলেটিরা তাদের কন্যা সন্তানকে বাংলাদেশে নিয়ে আসে বিয়ে দেওয়ার জন্য। তখন বর খোঁজা হয় চন্দ্রিমা — যেন সবদিকেই পারফেক্ট। চাঁদ ধরা গেলে আসে মোহরানার প্রশ্ন। তখনই বলা হয়, আমার মেয়ের কাবিন এক কোটি টাকা দিতে হবে। অথচ বরপক্ষের সেই টাকা দেওয়ার সামর্থ্য থাকে না। তবুও বিয়ে তো করতেই হবে — কপালে জুটবে সেই বোঝা। যদিও যান্ত্রিক জীবন হবে, সুখের চেয়ে টাকার হিসাব বেশি হবে। তবুও কাবিন ৫০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা লিখে ফেলা হচ্ছে। নগদ তো আর দিচ্ছে না — তাই অনেকে ভেবে বসে, লিখে রাখ, পরে দেখা যাবে।”
মনিরুজ্জামান মনির মনে করেন — এই অতি-আকাশছোঁয়া কাবিন এখন পুরো সিলেট অঞ্চলে এক ধরনের প্রদর্শনমূলক অহঙ্কার হয়ে গেছে, যা বাস্তবে বহু সংসার ভেঙে দিচ্ছে। তিনি বলেন,
“বিয়ে বন্ধনে আসলে এমনিতেই পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাই মুখ্য। মোহরানা যেন নিরাপত্তা হয় — শৃঙ্খল নয়।”
সালিশি বিচারকের অভিমত
সালিশি বিচারক মতিন বকস্, মৌলভীবাজার শহরের প্রখ্যাত সমাজকর্মী ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, বলেন:
“এখনও গ্রামে সালিশ হয়। কিন্তু ইসলামি নিয়ম জানে কয়জন? বরকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী মোহর দিতে হবে — এটা মানতে রাজি নয় অনেক পরিবার। আবার কনে পক্ষ অযথা বিশাল অঙ্ক দাবি করে। এতে সমাজে অশান্তি বাড়ছে।”
হিন্দু বিবাহ প্রথার সঙ্গে তুলনা
বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ে মোহরানার মতো আর্থিক চুক্তি নেই। সেখানে কন্যাদান প্রথা চালু, যা বহু শতাব্দী ধরে প্রচলিত। এখানে বরের পরিবারকে উপহার দেওয়া হয়, তবে তা বাধ্যতামূলক নয়। হিন্দু ধর্মে বিবাহকে ‘অটুট বন্ধন’ হিসেবে দেখা হয় — ফলে সামাজিক বিচ্ছেদ কম।
বাংলাদেশ বুরো অব স্ট্যাটিসটিক্স (BBS) এর ২০১৯ সালের হিসাব মতে, হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদের হার ৩–৫% মাত্র।
অন্যদিকে মুসলিম সমাজে শহরাঞ্চলে বিবাহ বিচ্ছেদের হার ২০–৩০% পর্যন্ত পৌঁছেছে।
কনে দেখা: সুন্নাহ বনাম বাস্তবতা
রাসূলুল্লাহ (স.) এর সুন্নাহ অনুযায়ী — বর নিজে কনেকে দেখে, কথা বলে সম্মতি দেবে। এতে ভুল বোঝাবুঝি, পছন্দের অমিল বা ভবিষ্যৎ দাম্পত্য দ্বন্দ্ব অনেকাংশে কমে যায়। অথচ বাংলাদেশে এখনো দেখা যায় — বাবা, চাচা, দুলাভাই বা বড় ভাই কনে দেখতে যান, বর নিজে দেখা থেকে দূরে থাকে। ফলে পরবর্তীতে মানসিক অমিল ও বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা
মিশকাতুল কোরআন মাদরাসার মোহতামিম শেখ সাদ আহমদ বর্ণভী বলেন, “যদি স্ত্রী ইসলামবিরোধী জীবনযাপন করে, তবে স্বামী খুলা বা শরীয়াহ সালিশের মাধ্যমে স্ত্রীকে বোঝাতে পারে মোহরানা ত্যাগ করতে। এটি জোরপূর্বক নয়, শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান।”
কুরআন শরীফে বলা হয়েছে:
“তোমরা নারীদের মোহর আনন্দের সাথে পরিপূর্ণভাবে প্রদান করো…” (সূরা নিসা, ৪:৪)
রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন:
“তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম হলো সেই ব্যক্তি, যে তার পরিবারের কাছে উত্তম আচরণ করে।” (তিরমিজি)
ইসলামে স্বামী যদি তালাক দেয়, তবে স্ত্রী মোহরানার পূর্ণ হকদার। কিন্তু যদি স্ত্রী ইসলামবিরোধী ও অনৈতিক আচরণ করে — তাহলে স্বামী খুলা প্রথার মাধ্যমে বিচ্ছেদ করতে পারে। খুলা হলো স্ত্রীর পক্ষ থেকে বিচ্ছেদের আবেদন, যেখানে স্ত্রী মোহর ফিরিয়ে দিয়ে মুক্তি নেবে। সহীহ বুখারি হাদিস (৫২৭৩) এ বর্ণিত — জামানা বিন্ত সাইয়্যাব রাসূলুল্লাহ (স.) কে খুলার আবেদন করেছিলেন।
সমাধানের পথ
১) সাধ্য অনুযায়ী মোহরানা নির্ধারণ:
অহেতুক প্রতিযোগিতা বাদ দিয়ে, বরের আর্থিক সক্ষমতা অনুযায়ী মোহরানা নির্ধারণ করতে হবে। এটি নারীকে সম্মান ও নিরাপত্তা দেয়।
২) বিয়ের আগেই পরিশোধ:
শারীরিক সম্পর্কের আগে মোহরানা সম্পূর্ণ পরিশোধ করতে হবে। এতে আইনি ও পারিবারিক জটিলতা কমবে।
৩) খুলা প্রথা সচল:
অনৈতিক স্ত্রীর ক্ষেত্রে স্বামী খুলা প্রথার মাধ্যমে বিচ্ছেদ করতে পারে। তবে এটি হতে হবে শরীয়াহ সালিশের মাধ্যমে, শান্তিপূর্ণভাবে।
৪) সুন্নাহ অনুযায়ী কনে দেখা:
বর নিজে কনেকে দেখে সম্মতি দেবে — এতে বিবাহ বিচ্ছেদ কমবে।
৫) সচেতনতা ও আইনগত সহায়তা:
শরীয়াহ কাউন্সেলিং, শর্ট কোর্ট, পারিবারিক সালিশ — এ ধরনের বিকল্প পদ্ধতি চালু করা জরুরি।
উপসংহার
মোহরানা কোনো দয়া নয় — এটি নারীর অধিকার। ইসলাম সহজ ও স্বচ্ছ পদ্ধতিতে বিবাহ চায়। অহেতুক বড় অঙ্ক লিখে পুরুষকে দাসে পরিণত করা ইসলাম সমর্থন করে না। একইসঙ্গে নারী যেন তার ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে অবহেলা না করে — এদিকেও নজর দিতে হবে।
সমাজ ও আইন একসঙ্গে সচল থাকলে — মোহরানা হবে নিরাপত্তা, শৃঙ্খল নয়। ইসলামী বিধান বাস্তবায়নই এ সমস্যার একমাত্র স্থায়ী সমাধান।
তথ্যসূত্র:
- কুরআন শরীফ (সূরা নিসা)
- সহীহ বুখারি (৫২৭৩), সহীহ মুসলিম, তিরমিজি
- বাংলাদেশ পারিবারিক আদালত আইন ১৯৬১
- বাংলাদেশ বুরো অব স্ট্যাটিসটিক্স (BBS)
- লাহোর হাই কোর্ট সমীক্ষা
- অধ্যাপক শামসুল আলম, কাজী হারুন উর রশীদ, অ্যাডভোকেট জাকির হোসেন ভূইয়া, শেখ সাদ আহমদ বর্ণভী, সালিশি বিচারক মতিন বকস্, ভুক্তভোগী স্বামীদের সাক্ষাৎকার
রূপান্তর সংবাদ-এ প্রতিনিধি হোন!
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে। আগ্রহীরা সিভি পাঠান: E-mail : rupantorsongbad@gmail.com
বিশেষ প্রতিবেদক : এস এম মেহেদী হাসান
সম্পাদনায় : আসমা/ তাবাসসুম/ সালেহ
Reporter Name 

























