1:36 pm, Sunday, 23 November 2025

নবীগঞ্জের রক্তাক্ত ফেসবুক পোস্ট: দুই গ্রামের দগদগে ক্ষত

  • Reporter Name
  • Update Time : 08:07:42 pm, Tuesday, 8 July 2025
  • 24 Time View

সিলেট । ৮ জুলাই ২০২৫-  “একটি পোস্ট, একটি মন্তব্য, আর তারপর — লাঠি, ইট, রক্ত, মৃত্যু। নবীগঞ্জ যেন হঠাৎই চুপসে যাওয়া এক গোপন ক্ষোভের বিস্ফোরণ দেখল!”

হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলা সদরের আনমুন আর তিমিরপুর — দুই গ্রাম পাশাপাশি থাকা সত্ত্বেও ভেতরে জমে থাকা দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। কিন্তু সেসব গোপন ক্ষোভ, রাজনৈতিক দলাদলি বা পারিবারিক শত্রুতা সবকিছুকে যেন এক নিমিষে জ্বালিয়ে দিল ফেসবুকের একটি পোস্ট।

সোমবার দুপুরে যখন লোকজনের চোখে রোদ্দুর জ্বলছে, তখনই দুই গ্রামের শত শত মানুষ নেমে এল রাস্তায় — হাতে লাঠি, ধারালো অস্ত্র, পকেটে পাথর। সংঘর্ষ এতটাই হঠাৎ আর তীব্র যে, দোকানপাট মুহূর্তেই বন্ধ, বাজারপাড়া শুনশান।

কারণ? স্থানীয় এক সাংবাদিক আশায়েদ আলীকে নিয়ে ফেসবুকে কয়েকটি পোস্ট ঘিরে প্রথমে কথার লড়াই। কারও মতে তিনি নিরপেক্ষ রিপোর্ট করেননি, কারও মতে তিনি ‘একপক্ষের হয়ে গেছে’। অভিযোগ, এই পোস্ট নিয়ে শুরু হয় তর্ক, তারপর কুরুক্ষেত্র।

একটি মৃত্যুর গল্প

সবচেয়ে বড় ক্ষতটা লেগেছে তিমিরপুর গ্রামের ফারুক তালুকদারের পরিবারে।
ফারুক ছিলেন একজন অ্যাম্বুলেন্সচালক — জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি অন্যের প্রাণ বাঁচাতেই রাস্তায় রাস্তায় ছুটতেন। কিন্তু সেই মানুষটিই প্রাণ হারালেন ফেসবুকের বিষাক্ত কথার খেলায় জন্ম নেওয়া সংঘর্ষে।

যখন দুই গ্রামের লাঠি আর ইট-পাটকেল উড়ছিল, ফারুক হয়তো ভাবতেও পারেননি তাঁর জীবন এভাবে থমকে যাবে। গুরুতর জখম হয়ে নবীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সেখান থেকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে — শেষ যাত্রার পথেই থেমে গেল ফারুকের বুকের ধুকপুকানি। শেরপুরে মহাসড়কের পাশে থমকে গেল এক প্রাণ।

১৪৪ ধারা, কিন্তু মানুষের মনে শঙ্কার ব্যারিকেড কোথায়?

সংঘর্ষে অন্তত শতাধিক মানুষ আহত, দোকানপাট লুটপাট, বাড়িঘরের সামনে আতঙ্কের ছায়া। প্রশাসন দৌড়ে গিয়ে জারি করেছে ১৪৪ ধারা — যেন অদৃশ্য এক দেয়াল তুলে দিয়েছে, আর কেউ যেন আর রক্ত না ঝরায়।

কিন্তু তাতেই কি সব শেষ? দুই গ্রামের মানুষের মুখে একই শঙ্কা — “পুলিশ গেলে আবার কিছু হবে না তো?”, “ফেসবুকে আবার কে কী লিখবে?” এই প্রশ্নের উত্তর নেই কারও কাছে।

কেন এমন হচ্ছে?

একসময় মাঠে ময়দানে কথা হতো। এখন তর্ক, অপমান, হুমকি চলে ফেসবুকের দেয়ালে। এক পোস্টে সম্মান গড়া যায়, আরেক পোস্টে রক্ত ঝরে যায়। গ্রামের মানুষ এখন আর শুধু হাওর, ক্ষেত আর হাটে সীমাবদ্ধ নয় — তারা এখন এক ক্লিকেই ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করতে পারে।

নবীগঞ্জের এই সংঘর্ষ সেই ভয়াবহ বাস্তবতাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল — প্রযুক্তি আর পুরনো শত্রুতার মিশেলে কীভাবে এক ফেসবুক পোস্টই হতে পারে সহিংসতার বিস্ফোরক!

ফারুকের শূন্য ঘর, গ্রামের শূন্য আস্থা

ফারুক তালুকদারের পরিবারের কান্না থামছে না। স্ত্রী, দুই সন্তান — এখনও ঠিকমতো বুঝতেই পারছে না, তাদের অভিভাবক কীভাবে আর কখন ফিরবে না।

আনমুন-তিমিরপুরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা এখন ভোরের বাজারে গিয়েও মুখ ঢেকে ফিসফিস করে কথা বলেন — কে কার পোস্টে কী বলেছে, কে কাকে ইন্ধন দিয়েছে? তাতে কিছু যায় আসে না। গ্রামের এক চায়ের দোকানদার বলল, “বড়রা যখন ফেসবুকে যুদ্ধ লাগায়, আমাদের বাঁচার রাস্তা কই?”

প্রশাসনের কী বলছে?

নবীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ কামরুজ্জামান জানিয়েছেন, “সংঘর্ষের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। এলাকায় উত্তেজনা ছড়াতে না পারে, সেজন্য পুরো নবীগঞ্জ শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। প্রয়োজনে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রুহুল আমিন বলেন, “অপ্রমাণিত খবর বা উসকানিমূলক পোস্টের কারণে যাতে আর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।” নবীগঞ্জ শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।

উপসংহার

এই সময়ের বাংলাদেশে শুধু হাতের মোবাইল আর ইন্টারনেট নয় — মানুষের হাতেই যেন একেকটা আগুনের বাক্স। নবীগঞ্জের রক্তাক্ত দুপুর সেই আগুনের ঝলকানি। প্রশ্ন উঠেছে — এই আগুন কি শুধু পুলিশের ১৪৪ ধারায় ঠেকানো যাবে? নাকি সময় এসেছে নতুনভাবে ভাবার — কোন কথা, কোন পোস্ট, আর কোন ক্ষোভ আসলে আমাদের কতটা ক্ষতবিক্ষত করছে!

কটি পোস্টে যে রক্তের গল্প লুকিয়ে থাকে, তা আরেকজনের ঘর ভাসিয়ে দেয় — নবীগঞ্জ তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।

রূপান্তর সংবাদ-এ প্রতিনিধি হোন!
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে। আগ্রহীরা সিভি পাঠান: E-mail : rupantorsongbad@gmail.com

প্রতিবেদক : মনিরুজ্জামান মনির

সম্পাদনায় : আসমা/ তাবাসসুম/ সালেহ

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Popular Post

দ্রব্যমূল্য কমানো ও সর্বস্তরে রেশনিং চালুর দাবি

নবীগঞ্জের রক্তাক্ত ফেসবুক পোস্ট: দুই গ্রামের দগদগে ক্ষত

Update Time : 08:07:42 pm, Tuesday, 8 July 2025

সিলেট । ৮ জুলাই ২০২৫-  “একটি পোস্ট, একটি মন্তব্য, আর তারপর — লাঠি, ইট, রক্ত, মৃত্যু। নবীগঞ্জ যেন হঠাৎই চুপসে যাওয়া এক গোপন ক্ষোভের বিস্ফোরণ দেখল!”

হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলা সদরের আনমুন আর তিমিরপুর — দুই গ্রাম পাশাপাশি থাকা সত্ত্বেও ভেতরে জমে থাকা দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। কিন্তু সেসব গোপন ক্ষোভ, রাজনৈতিক দলাদলি বা পারিবারিক শত্রুতা সবকিছুকে যেন এক নিমিষে জ্বালিয়ে দিল ফেসবুকের একটি পোস্ট।

সোমবার দুপুরে যখন লোকজনের চোখে রোদ্দুর জ্বলছে, তখনই দুই গ্রামের শত শত মানুষ নেমে এল রাস্তায় — হাতে লাঠি, ধারালো অস্ত্র, পকেটে পাথর। সংঘর্ষ এতটাই হঠাৎ আর তীব্র যে, দোকানপাট মুহূর্তেই বন্ধ, বাজারপাড়া শুনশান।

কারণ? স্থানীয় এক সাংবাদিক আশায়েদ আলীকে নিয়ে ফেসবুকে কয়েকটি পোস্ট ঘিরে প্রথমে কথার লড়াই। কারও মতে তিনি নিরপেক্ষ রিপোর্ট করেননি, কারও মতে তিনি ‘একপক্ষের হয়ে গেছে’। অভিযোগ, এই পোস্ট নিয়ে শুরু হয় তর্ক, তারপর কুরুক্ষেত্র।

একটি মৃত্যুর গল্প

সবচেয়ে বড় ক্ষতটা লেগেছে তিমিরপুর গ্রামের ফারুক তালুকদারের পরিবারে।
ফারুক ছিলেন একজন অ্যাম্বুলেন্সচালক — জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি অন্যের প্রাণ বাঁচাতেই রাস্তায় রাস্তায় ছুটতেন। কিন্তু সেই মানুষটিই প্রাণ হারালেন ফেসবুকের বিষাক্ত কথার খেলায় জন্ম নেওয়া সংঘর্ষে।

যখন দুই গ্রামের লাঠি আর ইট-পাটকেল উড়ছিল, ফারুক হয়তো ভাবতেও পারেননি তাঁর জীবন এভাবে থমকে যাবে। গুরুতর জখম হয়ে নবীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সেখান থেকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে — শেষ যাত্রার পথেই থেমে গেল ফারুকের বুকের ধুকপুকানি। শেরপুরে মহাসড়কের পাশে থমকে গেল এক প্রাণ।

১৪৪ ধারা, কিন্তু মানুষের মনে শঙ্কার ব্যারিকেড কোথায়?

সংঘর্ষে অন্তত শতাধিক মানুষ আহত, দোকানপাট লুটপাট, বাড়িঘরের সামনে আতঙ্কের ছায়া। প্রশাসন দৌড়ে গিয়ে জারি করেছে ১৪৪ ধারা — যেন অদৃশ্য এক দেয়াল তুলে দিয়েছে, আর কেউ যেন আর রক্ত না ঝরায়।

কিন্তু তাতেই কি সব শেষ? দুই গ্রামের মানুষের মুখে একই শঙ্কা — “পুলিশ গেলে আবার কিছু হবে না তো?”, “ফেসবুকে আবার কে কী লিখবে?” এই প্রশ্নের উত্তর নেই কারও কাছে।

কেন এমন হচ্ছে?

একসময় মাঠে ময়দানে কথা হতো। এখন তর্ক, অপমান, হুমকি চলে ফেসবুকের দেয়ালে। এক পোস্টে সম্মান গড়া যায়, আরেক পোস্টে রক্ত ঝরে যায়। গ্রামের মানুষ এখন আর শুধু হাওর, ক্ষেত আর হাটে সীমাবদ্ধ নয় — তারা এখন এক ক্লিকেই ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করতে পারে।

নবীগঞ্জের এই সংঘর্ষ সেই ভয়াবহ বাস্তবতাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল — প্রযুক্তি আর পুরনো শত্রুতার মিশেলে কীভাবে এক ফেসবুক পোস্টই হতে পারে সহিংসতার বিস্ফোরক!

ফারুকের শূন্য ঘর, গ্রামের শূন্য আস্থা

ফারুক তালুকদারের পরিবারের কান্না থামছে না। স্ত্রী, দুই সন্তান — এখনও ঠিকমতো বুঝতেই পারছে না, তাদের অভিভাবক কীভাবে আর কখন ফিরবে না।

আনমুন-তিমিরপুরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা এখন ভোরের বাজারে গিয়েও মুখ ঢেকে ফিসফিস করে কথা বলেন — কে কার পোস্টে কী বলেছে, কে কাকে ইন্ধন দিয়েছে? তাতে কিছু যায় আসে না। গ্রামের এক চায়ের দোকানদার বলল, “বড়রা যখন ফেসবুকে যুদ্ধ লাগায়, আমাদের বাঁচার রাস্তা কই?”

প্রশাসনের কী বলছে?

নবীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ কামরুজ্জামান জানিয়েছেন, “সংঘর্ষের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। এলাকায় উত্তেজনা ছড়াতে না পারে, সেজন্য পুরো নবীগঞ্জ শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। প্রয়োজনে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রুহুল আমিন বলেন, “অপ্রমাণিত খবর বা উসকানিমূলক পোস্টের কারণে যাতে আর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।” নবীগঞ্জ শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।

উপসংহার

এই সময়ের বাংলাদেশে শুধু হাতের মোবাইল আর ইন্টারনেট নয় — মানুষের হাতেই যেন একেকটা আগুনের বাক্স। নবীগঞ্জের রক্তাক্ত দুপুর সেই আগুনের ঝলকানি। প্রশ্ন উঠেছে — এই আগুন কি শুধু পুলিশের ১৪৪ ধারায় ঠেকানো যাবে? নাকি সময় এসেছে নতুনভাবে ভাবার — কোন কথা, কোন পোস্ট, আর কোন ক্ষোভ আসলে আমাদের কতটা ক্ষতবিক্ষত করছে!

কটি পোস্টে যে রক্তের গল্প লুকিয়ে থাকে, তা আরেকজনের ঘর ভাসিয়ে দেয় — নবীগঞ্জ তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।

রূপান্তর সংবাদ-এ প্রতিনিধি হোন!
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে। আগ্রহীরা সিভি পাঠান: E-mail : rupantorsongbad@gmail.com

প্রতিবেদক : মনিরুজ্জামান মনির

সম্পাদনায় : আসমা/ তাবাসসুম/ সালেহ