এস. এম. মেহেদী হাসান
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে, যেখানে সিলেটের সবুজ পাহাড় ভারতীয় সীমান্তের সঙ্গে মিলিত হয়েছে, সেখানে অবস্থিত একটি ৩৫০ একর আয়তনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাথরের ভাণ্ডার—“রেলওয়ে বাংকার” নামে পরিচিত। এক সময় বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃক কঠোরভাবে সংরক্ষিত এবং রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) প্রহরায় থাকা এই সংবেদনশীল প্রাকৃতিক অঞ্চলটি আজ পরিণত হয়েছে অবৈধ পাথর উত্তোলন, পরিবেশ ধ্বংস ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার এক ভয়াবহ কেন্দ্রে।
সরকারিভাবে নিষিদ্ধ এলাকা হওয়া সত্ত্বেও, এখানে দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে পাথর তোলা হয়—এমনকি যাদের এ কাজ ঠেকানোর দায়িত্ব, তাদের উপস্থিতিতেই। আরএনবি এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর পোশাকধারী সদস্যরা প্রায়শই ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও, তারা নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। শত শত শ্রমিক পাহাড় ও নদীর তলদেশ খুঁড়ে পাথর উত্তোলন করে কাঠের নৌকায় করে পরিবহন করে। স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রতিদিন শতাধিক নৌকা চলাচল করে এবং প্রতিটিতে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা ‘অনানুষ্ঠানিক’ ফি দেওয়া হয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের, যার মাধ্যমে গড়ে উঠেছে একটি লাভজনক কালোবাজারি ব্যবস্থা—যেখানে নিচুস্তরের কর্মকর্তারা সরাসরি লাভবান হন এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নীরব দর্শক।
পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা ভয়াবহ। এই তথাকথিত সংরক্ষিত এলাকার ৮০ শতাংশেরও বেশি অংশ ইতোমধ্যে উজাড় হয়ে গেছে। পাহাড়গুলো crater বা গর্তে পরিণত হয়েছে, এবং বর্ষার পানিতে সেগুলো পরিণত হচ্ছে রোগবাহী স্থির জলাশয়ে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমে যাচ্ছে, জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে, নদীপ্রবাহের গতি ও কাঠামো বদলে যাচ্ছে—যা দুই দেশের সীমান্তজুড়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত ভারসাম্যকে হুমকির মুখে ফেলছে।
এই ধ্বংসযজ্ঞের প্রভাব সিলেটের নিম্নাঞ্চলীয় এলাকা যেমন ভোলাগঞ্জ ও আশেপাশে আরও বেশি তীব্র। প্রতিবছর বর্ষাকালে, ভারতের উজানের বৃষ্টিপাতের অতিরিক্ত পানিতে এই অঞ্চল প্লাবিত হয়। অবৈধ খনন মাটি ক্ষয় ও প্রাকৃতিক জলনিষ্কাশন ব্যবস্থা নষ্ট করে, যার ফলে বন্যার তীব্রতা প্রতি বছর বেড়েই চলেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশনীতি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ রেজা বলেন:
“এই রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রশ্রয়প্রাপ্ত লুণ্ঠন দক্ষিণ এশিয়ার পরিবেশগত অখণ্ডতার ওপর সবচেয়ে বড় হুমকিগুলোর একটি। এটি শুধু ভূমিকে ধ্বংস করছে না, বরং গণতান্ত্রিক জবাবদিহি ও প্রাতিষ্ঠানিক নৈতিকতার ওপর জনগণের আস্থাকেও ভেঙে দিচ্ছে।”
পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আমিনা রহমান মন্তব্য করেন:
“সীমান্তবর্তী সংবেদনশীল অঞ্চলে এই অনিয়ন্ত্রিত খনন স্থানীয় জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে এবং জাতীয় পরিবেশ নিরাপত্তাকেও ঝুঁকিতে ফেলছে। জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর শাসন ও স্বচ্ছতা প্রয়োজন।”
এ পরিস্থিতি কেবল পরিবেশগতই নয়, তা এক জটিল ভূ-রাজনৈতিক সংকটও তৈরি করছে। বাংলাদেশের বদ্বীপীয় ভৌগোলিক অবস্থান একে প্রকৃতি-নির্ভর সমস্যার জন্য অতিমাত্রায় সংবেদনশীল করে তুলেছে। সীমান্ত এলাকায় পরিবেশ ধ্বংস ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে পানিবণ্টন ও ভূমি-ব্যবহার ইস্যুতে উত্তেজনা বাড়াতে পারে। উপরন্তু, বেসামরিক ও সামরিক কর্তৃপক্ষের মধ্যে দায়দায়িত্বের অস্পষ্টতা এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলছে।
স্থানীয় পরিবেশকর্মী ও কমিউনিটি নেতারা সংকটের তাৎক্ষণিক সমাধানের উপর জোর দিচ্ছেন:
- আ স ম সোহেল, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), মৌলভীবাজার শাখার সভাপতি বলেন:
“যদি কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত না করা হয়, এই সীমান্তের বাস্তুতন্ত্রের লাগাতার লুণ্ঠন স্থানীয় জনগণের জীবন ও প্রকৃতিকে চরম বিপদের মুখে ফেলবে।” - আইনজীবী মোস্তাক আহমদ মম বলেন:
“অভিযানের সময় গরিব মৌসুমি শ্রমিকদের ধরা হয়, কিন্তু পেছনের প্রভাবশালী মাস্টারমাইন্ডরা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে, ব্যবস্থাগত দুর্নীতির কারণেই।” - সিনিয়র সাংবাদিক ও প্রবাসী স্বজন ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের সভাপতি নুরুল ইসলাম শেফুল মন্তব্য করেন:
“এই সীমান্তবর্তী সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা না হলে ভবিষ্যতে আন্তঃসীমান্ত সংঘাত এড়ানো যাবে না।” - পরিবেশকর্মী সৈয়দ মুরাদ আহমদ চিশতি বলেন:
“মাত্র ৫ থেকে ১০ আগস্ট ২০২৪ এর মধ্যেই, জাফলং ও ভোলাগঞ্জ থেকে অবৈধভাবে উত্তোলিত পাথরের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১,০০০ কোটি টাকারও বেশি। এই কার্যক্রমে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, অথচ সরকার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।”
সরকারি প্রতিক্রিয়া ও অস্বীকৃতি
বহু আরএনবি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বীকার করেছেন:
“হ্যাঁ, কিছু আরএনবি সদস্য সরাসরি এই অবৈধ খননে জড়িত। এটা এখন ওপেন সিক্রেট। প্রতিটি নৌকা নির্দিষ্ট অর্থ দেয়, যা উপর পর্যন্ত ভাগ হয়। তাই কেউ কিছু বলে না।”
আশাবুল ইসলাম, আরএনবি পূর্ব জোনের প্রধান কমান্ড্যান্ট (সিআরবি, চট্টগ্রাম) বলেন:
“ভোলাগঞ্জের রেলওয়ে বাংকারে অবৈধ পাথর উত্তোলন হচ্ছে, এ কথা সত্যি। আমরা তা বন্ধ করার চেষ্টা করছি। তবে কর্মকর্তা লাভবান হচ্ছেন—এই অভিযোগ সত্য নয়।”
শফিকুল ইসলাম, আরএনবির ঢাকা বিভাগের কমান্ড্যান্ট (এই বাংকার তাঁর অধীন), বলেন:
“৫ আগস্টের পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে আমাদের ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়। আরএনবি সদস্যদের ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ আমি তদন্ত করব।”
লেফটেন্যান্ট কর্নেল নাজমুল হক, বিজিবি ব্যাটালিয়ন-৪৮ (সিলেট)-এর কমান্ডার বলেন:
“আমাদের মূল দায়িত্ব সীমান্ত সুরক্ষা। স্থানীয় প্রশাসনের অনুরোধ পেলে আমরা অবৈধ পাথর উত্তোলন ঠেকাতে সহযোগিতা করি।”
মানবিক ও নিরাপত্তাজনিত খরচ
শ্রমিকেরা স্বীকার করেছেন, তারা ঝুঁকি জেনেও খনন চালিয়ে যান কারণ “প্রত্যেক কর্মকর্তা তাদের অংশ পান।” সুনামগঞ্জের এক শ্রমিক জানান, “বিজিবিকে টাকা না দিলে তারা জরিমানা করে। সবাই ভাগ বসায়।” সীমান্ত ঘেঁষা এলাকায় খননের কারণে ভারতের সীমান্তরক্ষীরা অনেক সময় ভুল করে অনুপ্রবেশকারী শ্রমিকদের আটক করে, যার ফলে নিরাপত্তা ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়।
সরকার পাথর খননে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করলেও প্রয়োগে ঘাটতি রয়ে গেছে। পরিবেশগত ক্ষতি, বন্যা ঝুঁকি এবং ভূ-রাজনৈতিক পরিণতি সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। শুধু শ্রমিক নয়, বরং পোশাকধারী কর্মকর্তাদের এবং স্থানীয় ক্ষমতাশালীদের জবাবদিহির আওতায় না আনলে এ সংকট আরও ঘনীভূত হবে—ফলে হুমকির মুখে পড়বে আমাদের পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য এবং আঞ্চলিক শান্তি।
জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত একটি দেশ হিসেবে বৈশ্বিক মঞ্চে সক্রিয় বাংলাদেশকে আগে নিজের দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করতে হবে। না হলে, এই লুণ্ঠনের পরিণতি কেবল একটি পরিবেশগত বিপর্যয় নয়—বরং রাজনৈতিকও হতে পারে, যেখানে ব্যবস্থাগত দুর্নীতি এবং জন-অসন্তোষ একসাথে বিস্ফোরিত হতে পারে।
রূপান্তর সংবাদ-এ প্রতিনিধি হোন!
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে। আগ্রহীরা সিভি পাঠান: E-mail : rupantorsongbad@gmail.com
এস. এম. মেহেদী হাসান একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক, যিনি পরিবেশ, সীমান্ত নিরাপত্তা ও মানবাধিকার বিষয়ে কাজ করেন। তার লেখায় উঠে আসে প্রান্তিক মানুষের কথা এবং রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থার অন্তরালের বাস্তবতা।
সম্পাদনায় : সালেহ/ তাবাসসুম
Reporter Name 



























